দু’জন নিখোঁজ: অন্য দু’জনকে অপহরণের চেষ্টা!

বগুড়ার রজাকপুর গ্রামের শিশুরা কি নিরাপদ নয়?

অরূপ রতন শীল ও দোস্ত আউয়াল
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০১৯ ১৫:১৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬২০ বার।

বগুড়া সদরের রজাকপুর গ্রামের শিশুরা কি নিরাপদ নয়? প্রায় ষোল মাসের ব্যবধানে নিখোঁজ দুই শিশুর কোন সন্ধান  না পাওয়া এবং আরও অন্তত দু’জন শিশুকে অপহরণের চেষ্টা চালানোয় এমন প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে।
গ্রামবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির অভিযোগ, সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এমনকি সন্দেহভাজন এক অপহরণকারীকে আটক করে থানায় খবর দেওয়া হলেও পুলিশ কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। গ্রামবাসীর ধারণা, পুলিশের নির্লিপ্ততায় অপহরণকারী চক্রটি দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে ওই গ্রামের লোকজন তাদের ছোট ছেলে-মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। যে কারণে তারা কেউ তাদের শিশু সন্তানদের একা একা বাইরে যেতে দিচ্ছেন না এমনকি স্কুলেও নয়।
রজাকপুর গ্রামে দু’টি শিশু নিখোঁজ এবং আর দু’জনকে অপহরণ চেষ্টার ঘটনাটি জেলা জুড়ে বেশ আলোচিত হচ্ছে। শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার উত্তরে ওই গ্রামে যাওয়ার জন্য কারো কাছে পথ নির্দেশনা চাইলেই তিনি বলে ওঠেন ‘ওই গ্রামে তো ছোল ধরার (ছেলে ধরা-অপহরণকারী) উৎপাত বাড়ছে। দুই বাচ্চাক (শিশু) লিয়া গ্যাছে (নিয়ে গেছে) আরও দু’ড্যাক (দু’টি) লিবার (নিতে) লাগছিল।’ পুণ্ড্রকথা টিমের দুই সংবাদ কর্মীকেও স্থানীয় এক রিকশা-ভ্যান চালকের কাছ থেকে একই কথা শুনতে হয়েছে। বোঝা গেল অপহরণকারী চক্রকে গ্রামের লোকজন স্থানীয়ভাবে ‘ছোল ধরা’ বা ‘ছেলে ধরা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
যেভাবে দু’টি শিশু নিখোঁজ হলো
বগুড়া সদর উপজেলার নুনগোলা ইউনিয়নের রজাকপুর গ্রামে প্রথম শিশু নিখোঁজের ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর। ওই গ্রামের আসাদ আলীর পাঁচ বছরের কন্যা ইশা মনি দোকান থেকে বিস্কুট কেনার জন্য বাড়ি থেকে বের হয় কিন্তু আর ফিরে আসেনি। শিশু ইশা মনির নিখোঁজের ঘটনায় বগুড়া সদর থানায় যথারীতি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোন সন্ধান মেলেনি।
ইশা মনি নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ষোল মাস পর চলতি বছরের ২৯ মার্চ দোকানে বিস্কুট কিনতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি রিকশা চালক খায়রুল ইসলামের তিন সন্তানের সবার ছোট সাত বছরের মাহফুজ।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তার মা মিষ্টি বেগম কান্না জড়ানো কণ্ঠে পুণ্ড্রকথাকে বলেন, ‘সেদিন দুপুর ১২টার দিকে মাহফুজ বিস্কুট কেনার জন্য দোকানত যাবার সময় হামি গোসল করার জন্য ডাকি। তখন উঁই (সে) কয় মা হামি (আমি) তাড়াতাড়িই আসিচ্চি (আসছি)। কিন্তু তারপর আধঘন্টা যায় মাহফুজ আর আসে না। পরে হামি দোকানমুকে (দোকানের দিকে) যাই, এটি-উটি (এখানে-সেখানে) খুঁজি। কিন্তু কুন্টিও (কোথাও) হামার বাবার কোন খোঁজ পাইনি। তারপর থানা-পুলিশ করনু (জিডি) কিন্তু আজ দশদিন হয়্যা যাচ্চে হামার মাহফুজের কোন খোঁজ পাইনি।’
রজাকপুর গ্রামের শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিকী জানান, ষোল মাস আগে নিখোঁজ হওয়া শিশু ইশা মনির বাবা আসাদ আলী মানসিক রোগী। সে কারণে তার মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে গ্রামবাসী ততটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু মাহফুজ নিখোঁজ হওয়ার পর সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। 
আরও যে দুই শিশুকে অপহরণের চেষ্টা হয়েছিল
 গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ওই দুই শিশুর মত আরও দুই শিশুকেও অপহরণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল। তবে তারা নিজেদের বুদ্ধিমত্তায় শেষ পর্যন্ত নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। সৌভাগ্যবান ওই দুই শিশু হলো- আব্দুল বারীর মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সেজুতি এবং লুৎফর রহমানের ছেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র জিয়াদ হোসেন। 
অপহরণকারীদের কবল থেকে রক্ষা পাওয়া সেজুতি পু-্রকথাকে জানায়, একই গ্রামের তারু নামে এক যুবক প্রায় দেড় বছর আগে তাকে মিথ্যা কথা (মা-বাবা ডাকে) বলে পাশের বিলের ধারে নিয়ে গিয়েছিল। সে কান্না করলে তারু তাকে একটি খড়ের গাদার মধ্যে লুকিয়ে রাখে। কান্না করলে ছুুরিকাঘাত করা হবে বলেও সে হুমকি দিয়েছিল। পরে প্রতিবেশী এক মামির নাম ধরে ডাকাডাকি করলে তারু পালিয়ে যায় এবং সেই মামি এসে তাকে নিয়ে যায়। স্থানীয়রা জানান, তারু নামে ওই যুবক জিয়াদ হোসেনকে ছুরিকাঘাত করার হুমকি দিয়েছিল। গ্রামবাসীর ধারণা সেজুতির মত জিয়াদকেও অপহরণের চেষ্টা চালিয়েছিল তারু।
কে এই তারু? সে কি অপহরণ চক্রের সঙ্গে জড়িত?
রজাকপুর গ্রামের কৃষক হোসেন আলীর ছেলে তারেকুল ইসলাম গ্রামবাসীর কাছে তারু নামে পরিচিত। ১৮ বছর বয়সী তারুর বিরুদ্ধে এলাকায় একাধিক চুরিসহ দুই শিশুকে অপহরণ চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। গত ২৯ মার্চ শিশু মাহফুজ নিখোঁজ হওয়ার পর গ্রামবাসী তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। মাহফুজের মা মিষ্টি বেগমও তার ছেলে অপহরণের জন্য তারুকেই সন্দেহ করেন। তিনি বলেন, ‘নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন তারু হামাকেরক কাউকে না কয়্যা মাহফুজকে বাঘোইল গ্রামে হামার বাপের বাড়িত লিয়্যা গেছিল। সেদিন পাকা সড়ক থুয়্যা উঁই হামার ছলোক জমির মদ্যে দিয়্যা লিয়্যা গ্যাছে। তাছাড়া গেল পনের বিশদিন হলো ওর ভাগন্যা শাফিউল হামাকেরে বাড়িত যাওয়া আসা শুরু করে। একন মনে হচ্চে এগলা সব পরিকল্পনা করেই করা হচে’


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাহফুজ নিখোঁজ হওয়ার দু’দিনের মাথায় ৩১ মার্চ গ্রামবাসী ‘ছেলে ধরা’ বা অপহরণকারী সন্দেহে তারুকে আটক করে নুনগোলা ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যান। স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেছেন, তারু চেয়ারম্যানের কাছে বেশ কিছু তথ্য দেয়। নুনগোলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলীম উদ্দিন জানান, তারুকে আটক করে পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ না আসায় পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘শিশু নিখোঁজের ঘটনায় জিডি হলেও আমরা পুলিশের কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখছি না। এতে আমরা হতাশ। পুলিশ যদি অ্যাকটিভ হয় তাহলে শিশুটিকে হয়তো দ্রুত খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।’
তারু ও তার পরিবারের সবাই উধাও
গ্রামের শিশুদের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে যে যুবককে সন্দেহ করা হচ্ছে তারু নামে সেই যুবক এখন নিজেই উধাও। এমনকি তার বাবা-মাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারু প্রথমে অসুস্থতার কথা বলে প্রথমে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। এরপর সেখান থেকে পালিয়ে যায়। গ্রামবাসী মনে করেন তারেকুল ইসলাম তারু অপহরণকারী চক্রের সদস্য। তাকে গ্রেফতার করলেই অপহরণ রহস্য উন্মোচিত হবে।
পুলিশ কি বলছে
বগুড়া সদর থানার ওসি এস এম বদিউজ্জামান জানান, অপহৃত শিশুকে উদ্ধারের জন্য তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামবাসী অপহরণকারী সন্দেহে তারু নামে এক যুবককে আটক করে পুলিশে খবর দিলেও পুলিশ কেন তাকে গ্রেফতার করলো না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নুনগোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সন্দেহমূলক এক যুবককে মারপিট করে আমাদের ইনফর্ম করেছিলেন। আমরা তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের প্রমাণ চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি দিতে পারেন নি।’ ষোল মাস আগে আরও এক শিশুর অপহরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘বিষয়টি আমাদের জানা নেই।’