হাড় ভাঙ্গা রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছে না

বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ৫৭ বছরেও অর্থো-সার্জারি বিভাগ চালু হলো না

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৪২ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪৩৩ বার।

 

বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের শয্যা সংখা দুই দশক আগে আড়াই গুণ বাড়ানো হলেও তার বিপরীতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। উল্টো মঞ্জুর করা (নির্ধারিত) চিকিৎসকের ৩৪ শতাংশ পদই বর্তমানে ফাঁকা পড়ে আছে। নেই গুরুত্বপূর্ণ  অর্থো-সাজারি বিভাগও। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত বার্ণ ইউনিটের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হলেও এখন পর্যন্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এসব কারণে শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত ২৫০ শয্যার সরকারি ওই হাসপাতালে রোগীরা কাক্সিক্ষত চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চিকিৎসক সংকটের কারণে শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। ৫০০ শয্যার ওই হাসপাালে আড়াইগুণ বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। শজিমেক হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিপুল সংখ্যাক রোগী সামলাতে গিয়ে তাদের রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্থানীয় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে যদি চিকিৎসক নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত না করা যায়  তাহলে অতিরিক্ত রোগীর চাপে এক সময় শজিমেক হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবাই ভেঙ্গে পড়বে।
বগুড়া শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর নামে হাসপাতালটি নির্মাণ করা হয়। ১০০ শয্যার ওই হাসপাতালকে পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে হাসপাতালটিতে গড়ে ২৬০জন করে রোগী ভর্তি থাকে। আর বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৮০০জন চিকিৎসা নেন। তবে শয্যা সংখ্যা আড়াই গুণ বাড়ানো হলেও সেই অনুপাতে চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। উল্টো সেখানে চিকিৎসকের যে ৭৩টি পদ রয়েছে তার মধ্যে ২৩টিই শূণ্য পড়ে আছে।
হাসপাতালটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা সিনিয়র কনসালটেন্টের পদেই জনবল সবচেয়ে কম। ওই পদে ১১জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র দু’জন। একইভাবে জুনিয়র কনসালটেন্টের ১০টি পদের মধ্যে ৩টি ফাঁকা, আবাসিক মেডিকেল অফিসারের দু’টি পদের একটি, সহকারি রেজিস্ট্রারের ১৬টি পদের মধ্যে ৬টি, মেডিকেল অফিসারের ১৪টির মধ্যে তিনটি এবং প্যাথলজিস্টের দু’টি পদের মধ্যেও একটি ফাঁকা পড়ে আছে। এছাড়া মেডিকেল অফিসার শিশু এবং অ্যানেসথেসিওলজিস্টের পদগুলোতে কেউই নেই।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছরেও হাসপাতালটিতে অর্থো-সার্জারি বিভাগ চালু করা হয়নি। বছরের পর বছর চিঠি চালাচালি করা হলেও কোন কাজ হয়নি। ফলে সড়ক দূর্ঘটনা কিংবা অন্য কোন ঘটনায় হাড় ভাঙ্গাজনিত ক্ষত নিয়ে আসা রোগীদের ভর্তি না করিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে হাড়ের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের সার্জারি বিভাগের এক চিকিৎসক শুধু বর্হিবিভাগে পরামর্শ দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতিপূর্বে হাসপাতালটি যখন জেলা সিভিল সার্জন দপ্তরের অধীনে ছিল তখন বিকল্প হিসেবে উপজেলা হাসপাতালগুলো থেকে অর্থো-সাজারি বিভাগের চিকিৎসকদরকে প্রেষণে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আনা হতো এবং হাড়ের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দেয়া হতো। কিন্তু কয়েক বছর আগে ওই হাসপাতালটি সিভিল সার্জনের দপ্তর থেকে আলাদা হয়ে নিজস্ব প্রশাসন অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় বিকল্প পদ্ধতিতে সেই চিকিৎসক আনাও আর সম্ভব হচ্ছে না।
ফরিদ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি তার ভাঙ্গা হাত নিয়ে শনিবার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে এসেছিলেন। অর্থো-সার্জারি নামে কোন বিভাগ কিংবা তার কোন চিকিৎসক না থাকায় তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ফরিদ উদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘এত বড় হাসপাতাল। অথচ সামান্য একটা ভাঙ্গা হাতের চিকিৎসা দেওয়ার মত ডাক্তার নাই-এটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ শয্যার একটি বার্ণ ইউনিট নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হলেই সেটি ব্যবহার উপযোগী হবে। কিন্তু হাসপাতাল প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, বার্ণ ইউনিটের নির্মাণ সম্পন্ন হলেও তার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। যে কারণে সেটি সহসা চালুর সম্ভাবনাও কম। তারা আরও জানিয়েছেন, হাসপাতালের জন্য ডিজিটাল এক্সরে মেশিন সরবরাহ করা হলেও বিদ্যুৎ সংযোগে প্রদানের ক্ষেত্রে কারিগরি কিছু সমস্যার কারণে তা আজও বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে।
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের সহকারি পরিচালক ডা. আব্দুল ওয়াদুদ জানান, ৫০০ শয্যার ওই হাসপাতালে ১ হাজার ৩১৮জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এত বিপুল সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। তার মতে যদি শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার আওতা বাড়ানো যেত তাহলে হয়তো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অতিরিক্ত রোগীর সংখ্যা কমানো যেত। সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বগুড়ার সভাপতি মাছুদার রহমান হেলাল বলেন, ‘সনাকের পক্ষ থেকে আমরা মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছি। শয্যার বিপরীতে চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি না করায় এখানে কাক্সিক্ষত চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের চাপ বাড়ছে। যদি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানো না যায় তাহলে হয়তো মেডিকেল কলেজ হাসপতালের চিকিৎসা সেবাই ভেঙ্গে পড়বে।’
যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এটিএম নুরুজ্জামান জানান, সীমিত জনবল নিয়ে তারা রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘শয্যার বিপরীতে চিকিৎসকের পদ সৃষ্টি এবং বর্তমানে শূণ্য পদগুলো পূরণে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছি। পাশাপাশি অর্থো-সার্জারী বিভাগ চালু এবং বার্ণ ইউনিটের জন্যও জনবল চাওয়া হয়েছে। এগুলো পেলে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার মান কয়েকধাপ বৃদ্ধি পাবে।’