বগুড়ায় এবার বৈশাখী মেলা চলবে ৬দিন

এসেছে নতুন সূর্য, শুভ নববর্ষ

বিশেষ রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:২৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৮৭৭ বার।

অন্য দিনের সূর্যোদয়ের চেয়ে বছরের প্রথম দিনে জেগে ওঠা সূর্যের ভিন্নতা রয়েছে। আবহমান বাংলার গ্রামীণ উৎসব এখন ছুঁয়েছে নগর জীবনও। সর্বত্র উদযাপিত হচ্ছে বাংলার উৎসব, উচ্চারিত হচ্ছে বাঙালিয়ানার জয়গান; যে গানের সুরে আপন শক্তিতে জেগে ওঠার শুভক্ষণ। পঞ্জিকার পাতা বদলে আজ রোববার পহেলা বৈশাখ। মনে করিয়ে দিচ্ছে ফেলে আসা শিকড়ের কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের মতে সেই তো একইভাবে সূর্য ওঠে এবং অস্ত যায়, দিনের আলো নিভে যায়, ঘনায় আঁধার। তারপরের দিন বা আগের দিনের থেকে পহেলা বৈশাখ তবু আলাদা। কেননা, পহেলা বৈশাখকে আমরা ভালোবাসার চোখে দেখি এবং এই দেখার একটা তাৎপর্য রয়েছে।
বৈদিক যুগে বাংলা সনের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব মুর্শিদকুলি খান সর্বপ্রথম বৈশাখ মাস থেকে বাংলায় খাজনা আদায় শুরু করেন। লোকগবেষক শামসুজ্জামান খান নিজস্ব অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে জানান, সম্ভবত সতেরো শতাব্দীতে মুর্শিদকুলি খান সে সময়ের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বৈশাখকে বছরের প্রথম মাস নির্ধারণ করেন। তিনি বলেন, 'একটা সময় বর্ষবরণ গ্রাম বাংলার উৎসব ছিল, শহরে বিচ্ছিন্নভাবে হতো। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ঢাকায় বর্ষবরণ উৎসব হতো, তবে সেটা ব্যাপক ভিত্তিতে ছিল না। পাকিস্তান হওয়ার পর বাঙালি মুসলমানরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় নববর্ষ পালন শুরু করে।
বর্তমানে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে মুখ্য হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, যা প্রবর্তনের কৃতিত্ব পুরোটুকুই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি শান্তিনিকেতনে প্রথম ঋতুভিত্তিক উৎসবের আয়োজন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলার প্রান্ত থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ে বর্ষবরণের আয়োজন। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্র চর্চা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল, এই চেষ্টা প্রতিরোধেরও অংশ হয়ে গিয়েছিল বর্ষবরণের আয়োজন। ১৯৬৭ সালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রভাতি আয়োজনে বড় একটা অংশজুড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের গান এবং এখনও তা আছে। বর্ষবরণের এই আয়োজনের সঙ্গে স্বৈরাচারী এরশাদের সময় প্রতিবাদী মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করতে শুরু করেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকরা। সব মিলিয়ে এখন ঢাকায় যেভাবে বর্ষবরণ হয়, কলকাতাতেও হয় না। এমনকি আমাদের দেশের জেলা-উপজেলাতেও বর্ষবরণের সার্বজনীন আয়োজন ছড়িয়ে গেছে সবখানে।
বগুড়ায় বর্ষবরণের মূল এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন বৈশাখী মেলা। গ্রামাঞ্চলে মেলাগুলো একদিনের হলেও শহরে তা চলে অন্তত পাঁচদিন। প্রায় চার দশকের ব্যবধানে শহরের সেই মেলার আয়োজন এবং আয়তন এতটাই বেড়েছে যে এখন স্রোতের মত আসা মানুষের ভিড়ে প্রধান সড়কগুলোই যেন হারিয়ে যায়।
তবে এবার শহরে আয়োজিত বৈশাখী মেলার মেয়াদ একদিন বাড়িয়ে ছয়দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। আয়োজক বগুড়া থিয়েটারের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন উৎসব প্রিয় বগুড়াবাসীর অনুরোধেই মেলার সময়-সীমা বাড়ানো হয়েছে। শহরের জিরো পয়েন্টের কাছে পৌর পার্কের বৈশাখী মেলায় পালা গান, পুতুল নাচ, লাঠি খেলা, মোরগ লড়াই, পাতা ও সাপ খেলার মত গ্রামীণ লোক সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ স্থান পেয়ে থাকে। আর নিজ সংস্কৃতির সেই ঐতিহ্যের স্বরূপগুলো দেখতে কর্মব্যস্ত শহুরে মানুষগুলো তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ছুটে যান বৈশাখী মেলায়। বাঙালিয়ানার স্বাদ নিতে ধর্মীয় পরিচয় ভুলে তারা মেতে উঠেন সার্বজীনন এক উৎসবে। 
আয়োজকরা জানিয়েছেন, এবার  শুধু মেলার সময়-সীমাই বাড়ছে না, আয়োজনেও থাকছে ভিন্নতা। এই প্রথম মেলা প্রাঙ্গণের উন্মুক্ত মঞ্চে স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতদিন দু’টি করে ছয় দিনে ১২টি নাটক মঞ্চস্থ করা হবে। এছাড়াও মেলার শেষ দিন থাকছে সিরাজ-উদ-দৌলা যাত্রাপালা।
আয়োকজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বগুড়া থিয়েটারের পক্ষ থেকে এ জেলায় বৈশাখী মেলার প্রথম আয়োজন করা হয় ১৩৮৮ বঙ্গাব্দে (১৯৮১ খ্রীস্টাব্দ)। আয়োজকদের একজন তৌফিক হাসান ময়না জানান, ১৯৮০ সালে বগুড়া থিয়েটার গঠিত হওয়ার পরের বছরই তারা মেলার গোড়া পত্তন করেন। বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে মেলা আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, এটি গ্রাম থিয়েটারের একটি দর্শন বলা যেতে পারে। এর উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত নাট্যগুরু ড. সেলিম আল দীন। বাঙালির যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা তা গ্রামীণ লোক সংস্কৃতি লালনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি বৈশাখী মেলার গোড়া পত্তন করতে বলেছিলেন। একই সঙ্গে যেসব ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে সেগুলোকেও মেলা আয়োজনের মাধ্যমে রক্ষা করা সম্ভব বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন। তার মতে বাঙালির যে সংস্কৃতি সেটি চর্চার মাধ্যমেই সব ধর্ম মতকে এক সুতোয় গাঁথা সম্ভব। 
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মেলায় লোক সমাগম বেড়ে যাওয়ায় দোকানের সংখ্যাও বেড়েছে। হরেক রকম পণ্যে ঠাসা দোকানগুলো এখন মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সড়কের দুই পাশের জায়গা দখল করে নেয়। ভেতরে-বাইরে সব মিলিয়ে অন্তত দেড় শতাধিক দোকানে মেলার শেষ দিন পর্যন্ত বেচা-কেনা চলে। আর বৈশাখ উপলক্ষ্যে শহরের বিপনী বিতানগুলোতে তো চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। ছেলেদের ফতুয়া, পাজামা-পাঞ্জাবী আর মেয়েদের শাড়ি বরাবরই বিক্রির শীর্ষে রয়েছে। এছাড়া ফুল, মিষ্টি এবং দইয়ের বেচা-কেনাও বেড়ে গেছে। কয়েকগুণ। বৈশাখী মেলার আয়োকজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেলার প্রথম আর শেষ দিন সবচেয়ে বেশি বেচা-কেনা হয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কম করে হলেও ২৫ লাখ টাকার পণ্য বেচা-কেনা হয়। অন্যদিকে বিপনী বিতান মালিকদের হিসাব অনুুযায়ী বাংলা নববর্ষ উদযাপনের দিনটিকে ঘিরে প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।
শহরের বাইরে শাজাহানপুর উপজেলার বারআঞ্জুল গ্রামে একদিনের বৈশাখী মেলা  বসে। এছাড়া গাবতলী উপজেলার গোলাবাড়ি এবং শিবগঞ্জ উপজেলারও একাধিক স্থানে একদিনের মেলা বসে। গ্রামীণ এসব মেলায় অবশ্য বড়দের তুলনায় ছোটদের উপস্থিতিই বেশি চোখে পড়ে। জেলার শাজাহানপুরের পালপাড়া এবং গাবতলী উপজেলার বামুনিয়া কুমার পল্লীতে উৎপাদিত মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল এবং দুপচাঁচিয়া উপজেলার খোলাশ গ্রামের কারিগরদের তৈরি প্লাস্টিকের খেলনা সামগ্রীই মেলার প্রধান আকর্ষণ। তবে এসব পণ্য শুধু বগুড়াতেই নয় আশ-পাশের জেলার মেলাগুলোতেও বিক্রি হয়।
বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. গাজী তৌহিদুল আলম চৌধুরী বলেন, পহেলা বৈশাখ মানে পুরানোকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। গ্রামাঞ্চলে বর্ষবরণের এই উৎসব চিরায়ত। তার মতে, দিন, মাস আর বছর গণনায় বাংলা পঞ্জিকা যাদের নিত্য সঙ্গী, তাদের কাছে পহেলা বৈশাখ শুধু একটি দিন কিংবা তারিখ নয় বরং আপন সংস্কৃতিকে আঁকড়ে থাকারই লড়াই। তিনি বলেন, ‘গ্রামে হয়তো শহরের মত উৎসবের আয়োজন হয় না কিন্তু পহেলা বৈশাখের উপস্থিতি প্রতিটি ঘরেই মিলবে।’
বগুড়া আর্ট কলেজের প্রভাষক অনীক রেজা জানান, প্রতি বছরের মত এবারও আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিবেন। তিনি বলেন, এবার আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ¯œাতক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন বলে গতবারের মত ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে পারিনি। তবে তার পরেও আয়োজনের কমতি থাকবে না।’
বগুড়ার বিশিষ্ট লেখক বজলুল করিম বাহার মনে করেন বৈশাখী মেলা আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিরই অংশ। বগুড়া থিয়েটারের বৈশাখী মেলা আয়োজনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করছে-এটা অবশ্যই ভাল একটা উদ্যোগ। আমি মনে করি বাংলা নববর্ষকে আরও ভালভাবে পালন করা উচিত। ঈদের দিন যদি আমরা নতুন কাপড় পড়তে পরি। ভাল খেতে পারি। তাহলে বছরের প্রথম দিন হিসেবে পহেলা বৈশাখেও কেন আমরা তা করতে পারবো না?’