কোরআন নাযিলের ইতিহাস- ৪ঃ রাসূল সা: নবুওয়তের বিরাট দায়িত্ব পেলেন

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০১৯ ১৬:৫৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ২৬৬ বার।



সূরা আলাকের প্রাথমিক পাঁচটি আয়াত ছিলো প্রথম নাযিলকৃত ওহী। উক্ত ৫টি আয়াতে রাসূল সা: -এর ওপর কোন্ বিরাট কাজের দায়িত্ব পড়েছে, সেই বিষয়ে তাঁকে কি করতে হবে?- সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি, নির্দেশনাও দেয়া হয়নি। কেবলমাত্র আল্লাহ্ সম্পর্কে প্রাথমিক পরিচিতি ঘটিয়ে তাঁকে কিছুদিন অবসর দেয়া হলো। প্রথম ওহী নাযিলের পর তিনি যে চাপ অনুভব করেছিলেন তা প্রশমনের জন্য কিছুদিন সময় দেয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে তিনি যেন ভবিষ্যতের গুরু দায়িত্ব নিতে পারেন সেই মানসিক প্রস্তুতির জন্য আল্লাহ্ কিছু সময় ওহীর আগমন বিলম্ব করলেন। সেই অবসর কাল যখন অতিক্রান্ত হলো তখন  সুরা মুদ্দাসসির-এর প্রাথমিক সাতটি আয়াত নাযিল করা হলো- “হে কম্বল আবৃত (মোহাম্মদ)। (কম্বল ছেড়ে) ওঠো এবং মানুষদের (পরকালের আযাব সম্পর্কে) সাবধান করো। তোমার মালিকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। আর তোমার পোশাক আশাক পবিত্র করো। এবং (যাবতীয়) মলিনতা ও অপবিত্রতা পরিহার করো। কখনো বেশি পাওয়ার লোভে কাউকে কিছু দান করো না। তোমার মালিকের (খুশির) উদ্দেশ্যে ধৈর্য্য ধারণ করো। এই আয়াতগুলোর মাধ্যমেই তাঁকে প্রথমবারের মতো নবুওয়তের দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হলো। 


সুরা মুদ্দাসসির-এর প্রথম তিনটি আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ রাসূল সা: -কে যেসব নির্দেশনা দিলেন সেটার মর্মার্থ এই যে- “হে আমার প্রিয় বান্দা, তুমি চাদর জড়িয়ে শুয়ে পড়লে কেন? তোমার ওপর তো একটা বিরাট কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ঐ দায়িত্ব পালনের জন্য তোমাকে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তুমি উঠে সতর্ক করো ঐ সমস্ত লোকদের যারা আল্লাহ্কে উপেক্ষা করে দিন কাটাচ্ছে। তাদেরকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখাও। তাদেরকে সতর্ক করে দাও আল্লাহ্র জমীন কোনো স্বেচ্ছাচারিতা-অরাজকতার জায়গা নয়, যা ইচ্ছা তা করা যাবে না। প্রত্যেকের কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং পাপ কাজের প্রতিফল ভোগ করতে হবে। উচ্চ কণ্ঠে তোমার রব-এর শ্রেষ্ঠত্ব-বড়ত্ব-এর ঘোষণা করো। সারা বিশ্বের সবাইকে জানিয়ে দাও বিশ্ব জাহানে একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো শ্রেষ্ঠত্ব-বড়ত্ব-প্রাধান্য নাই।”


এরপর সুরা মুদ্দাসসির-এর ৪র্থ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালা রাসূল সা: -কে নিজের পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখার নির্দেশনা দিলেন। রাসূল সা:  যে জনপদে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন সেইসব জনগোষ্ঠীর মাঝে পবিত্রতার সামান্যতম জ্ঞানও ছিল না। সেইসব জনগোষ্ঠীকে পবিত্রতার ধারনা দিতে আল্লাহ্ তায়ালা পোশাক-আশাক পবিত্র রাখার কথাটি বললেন। পোশাক-পরিচ্ছদকে পবিত্র রাখলে তা মন-মানসিকতাকেও পবিত্র রাখে। সেইসাথে তা আত্মার পবিত্রতাও বয়ে আনে। পোশাকের পবিত্রতার সাথে দেহ ও মনের পবিত্রতাও সম্পর্কযুক্ত। পরিচ্ছন্ন পোশাক মানেই দেহের, মনের ও আত্মার পবিত্রতা। পরিচ্ছন্ন পোশাক সবসময় সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক। একজন পবিত্র মনের মানুষ কখনোই অপরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে না এবং দেহকেও অপবিত্র রাখে না । 
এরপর সুরা মুদ্দাসসির-এর ৫ম আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালা রাসূল সা: -কে যাবতীয় মলিনতা ও অপবিত্রতা পরিহার করার নির্দেশনা দিলেন। মলিনতা-অপবিত্রতা বলতে সর্বপ্রকার খারাপ জিনিস বুঝানো হয়েছে। মানুষের ভ্রান্ত বিশ্বাস-চিন্তা-চেতনা এবং অনৈতিক চরিত্র ও অসৎ কাজকর্ম ইত্যাদি সামগ্রিকভাবে মলিনতা-অপবিত্রতা-পুতিগন্ধময় অবস্থা। এখানে  রাসূল সা: -কে নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে সমাজের চর্তুদিকে এই যে অপবিত্র দুর্গন্ধময় পরিবেশ তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখ। কেউই যেন বলতে না পারে তুমি লোকজনকে যেসব কাজ কর্ম থেকে বিরত থাকতে বলছো সেটার কোনো একটা তোমার নিজের মধ্যেই আছে।  


এরপর সুরা মুদ্দাসসির-এর ৬ষ্ঠ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালা রাসূল সা: -কে নির্দেশ দিলেন যে, কখনো বেশি পাওয়ার লোভে কাউকে কিছু দান করো না। অর্থাৎ  অধিক পাওয়ার উদ্দেশ্যে কাউকে কিছু দান করো না। এখানে  রাসূল সা: -কে নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে যে - তোমার দান, অনুগ্রহ, মহানুভবতা, উত্তম আচরণ ইত্যাদি যাবতীয় কর্ম করতে হবে শুধু আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য। যা কিছু করবে, সেটা করবে নিঃস্বার্থভাবে, কোনোরূপ বিনিময় পাওয়ার আশায় নয়। কারণ আল্লাহ্র দয়া ও ইচ্ছার ফলেই তো যাবতীয় বড় বড় ও মহান কাজ সুসম্পন করা সম্ভব হয়।


অতপর সুরা মুদ্দাসসির-এর ৭ম আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালা রাসূল সা: -কে নির্দেশ দিলেন  যে,  তোমার নিজের রব-এর জন্য ধৈর্য্য ধারণ কর। এখানে এই আয়াতটির মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালা রাসূল সা: -কে এই কথাই বোঝাচ্ছেন যে- নবুয়তের যে কাজটি তোমার উপর সঁপে দেয়া হয়েছে তা বড়ই দায়িত্বপূর্ণ ও নিদারুন কষ্টসাধ্য। এই কাজ করতে যেয়ে বহু দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে। তোমার নিজের জাতি তোমাকে ঘর থেকে বের করে দিবে। সমগ্র আরব জাহান তোমার বিরুদ্ধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যাবে। অতীতের সকল নবী রাসূলগণের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাই আল্লাহ্র পথে আহ্বান করার জন্য তোমার বিপক্ষে যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন হাসিমুখে তুমি তা সহ্য করবে এবং ধৈর্য্য ধরবে। দৃঢ়তা ও স্থিতিশীলতা সহকারে নবুয়তের কর্তব্য পালন করবে। ভয়, লোভ-লালসা, বন্ধুত্ব-শত্রুতা, ভালবাসা-ঘৃণা ইত্যাদি অনেক কিছু তোমার এই কাজের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু এসব সকল কিছুই তুমি উপেক্ষা করে আল্লাহর উপর ধৈর্য্য রেখে দ্বীনের কাজ চালিয়ে যেতে থাকবে। 


সূতরাং উক্ত সাতটি আয়াতের মাধ্যমে বোঝা গেলো যে, আল্লাহ্তায়ালা রাসূল সা: -কে নবুয়তের দায়িত্ব পালনের জন্য কতগুলো নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি তাঁকে শয্যা ছেড়ে উঠে নাফরমানদের সতর্ক করতে বলছেন, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে সর্বত্র আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে বলছেন। আর এই কাজ করতে যেয়ে নিজেকে পবিত্র রাখতে বলছেন এবং সর্বপ্রকার সামাজিক পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে বলছেন। আর আল্লাহ্র পথে মানুষকে ডাকার জন্য,উত্তম কার্যাবলী ও অনুগ্রহ প্রদর্শনের জন্য কোনোরূপ বিনিময় গ্রহণের প্রত্যাশা করতে নিষেধ করছেন। সবশেষে আল্লাহ্র পথে আহ্বান করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে যত বাধাই আসুক না কেন সেক্ষেত্রে আল্লাহ্র উপর ধৈর্য্য ধারণ করতে বলেছেন।

চলবে...