কোরআন নাযিলের ইতিহাস-৫: রাসূল সা: -এর দাওয়াতে মক্কায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:৪১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৭০৬ বার।

সুরা মুদ্দাসসির-এর সাতটি আয়াতের মাধ্যমে রাসূল সা: -এর প্রতি আল্লাহ্র  আহ্বান ছিলো যে, প্রচ- শিরক-এ মত্ত থাকা শক্তিশালী কোরাইশ ও আরব জাতিকে সাবধান করা এবং তাদের কাছে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা। আর দ্বীনি দাওয়াতের কাজে যে সব বড় বড় শক্তি প্রতিবন্ধক বলে মনে হয় তাদের চেয়ে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব অনেক বেশি সেটা প্রচার করা। মুশরিকদের দ্বারা পবিত্র মক্কা শরীফকে সমগ্র আরব জাতির জন্যে শিরক-এর কেন্দ্রস্থল বানানো হয়েছিলো। এমন জায়গা-অবস্থা-পরিবেশ থেকে তাওহীদের ঘোষণা দেয়া রাসূল সা: -এর জন্য দারুণ কঠিন ও প্রাণ হরণকারী কাজ ছিলো। কিন্তু আল্লাহ্র আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি একাকী বিরুদ্ধবাদীদের বিপক্ষে লড়াই শুরু করতে বিন্দুমাত্র ভয় করেননি। আল্লাহ্র ফরমান যথাযথভাবে পালনের জন্য নবী করিম সা: ইসলাম প্রচার শুরু করে দিলেন। 


রাসূল সা: -এর ইসলাম প্রচার শুরুর সাথে সাথে মক্কায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এদিকে দেখতে দেখতে রাসূল সা:    -এর তাবলীগ ও দাওয়াতের কার্যক্রম কয়েকটি মাস অতিবাহিত হলো। এক সময় ওকাজের মেলার মাস উপস্থিত হলো। তখন মক্কার লোকজনদের মনে চিন্তা-ভাবনা জেগে উঠলো যে, “ মেলার সময় উপস্থিত জনগণের মাঝে যদি মুহাম্মদ সা: কোরআনের মর্মবাণী প্রচার করতে থাকেন তবে অবস্থা তো বেগতিক হয়ে পড়বে। কুরআনের ন্যায় তুলনাহীন ও মর্মস্পর্শী কালাম পাঠ শুনালে তো সেই দাওয়াত সমগ্র আরব জাহানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যাবে। এর ফলে অসংখ্য মানুষ প্রভাবিত হয়ে পড়বে।” 


এই পেরেশানি থেকে বাঁচার জন্য এবং মুহাম্মদ সা:-এর দাওয়াতী কাজ প্রতিহত করার উপায় নির্ধারণ করার জন্য তারা একটি সম্মেলন ডাকলো। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হলো যে মুহাম্মদ সা: -এর বিপক্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রোপাগান্ডা শুরু করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? তারা ভাবলো, সবাই যদি দলে দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলে তবে মেলায় আগত জনগণ সে কথায় বিশ্বাস করবে না। তাই তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট একটি কথা বলতে হবে। কমিটির সদস্যদের একজন অলীদ ইবনে মুগীরা বললো−“তোমরা যদি মুহাম্মদ সা: -এর বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলো তবে কেউ তা বিশ্বাস করবে না। সবাইকে একটি কথাই ঠিক করে নিতে হবে। সকলের নিকট একই কথা বারবার বলতে হবে। মুগীরার কথায় তখন অনেকেই সায় দিয়ে বললো−“আমরা বলবো যে তিনি গণক”। মুগীরা বললো, আল্লাহ্র নামে শপথ নিয়ে বলছি সে গণক নয়। আমরা অনেক গণক দেখেছি যারা গুণ গুণ করে যে বাক্য রচনা করে তার সাথে কোরআনের আয়াতের দূরতম সম্পর্ক নাই।” তখন অন্য একদল লোক বললো−“বলতে হবে তাঁকে জ্বিনে ধরছে।” মুগীরা উত্তরে বললো−“জ্বিনে প্রভাবিত পাগল ধরণের লোক জীবনে কম দেখি নাই। জ্বিনে ধরা পাগলরা যেসব অসলংগ্ন কথা বলে, যে উদ্দেশ্যহীন চলাফেরা করে, যে প্রলাপ বকে মুহাম্মদ সা: -এর কাজকর্মের সাথে তা মিলে না, আর জনগণ কোরআনের বক্তব্যকে প্রলাপ বলে বিশ্বাস করবে না। জ্বিনাহত পাগলরা যেসব অর্থহীন কথা বলে কোরআন তা বলে না।” তখন লোকেরা বললো−‘তবে আমরা বলবো তিনি কবি।’ মুগীরা উত্তরে বললো−“কবিতা কত প্রকার, কি কি হতে পারে তা আমি জানি। কোরআনের কালামকে কিছুতেই কাব্য-কবিতা বলা যাবে না।” তখন লোকেরা বললো−“তা হলে তাঁকে জাদুকর বলতে হবে।” মুগীরা উত্তরে বললো−“তাঁকে জাদুকরও বলা যাবে না। কারণ জাদুকররা কি কলা কৌশল করে তা আমরা জানি। যাদু দেখানোর ভেলকি আমাদের নখদর্পনে। তাই তাঁকে জাদুকর বলার অবকাশ নাই। মুহাম্মদ সা: -কে কিছুতেই জাদুকর বলা যায় না।” সবশেষে মুগীরা বললো−“তোমরা যতগুলো প্রস্তাব দিলে সেটার একটিও যদি বলা হয় তবে সমাগত জনগণ তা উড়িয়ে দেবে। মুগীরা বললো−“আল্লাহর কসম এই কালামে খুব বেশি মাধুর্য আছে। এটার শিকড় অতিশয় গভীর, এর শাখা প্রশাখা ফলধারক।” 
এসব আলোচনা শোনার পর আবু জেহেল মুগীরাকে ধমক দিয়ে বললো−তুমি তাড়াতাড়ি প্রচারণার কথাটি বলে দাও। তা না হলে জনগণ তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা ভাববে তুমি মুহাম্মদের লোক। তখন মুগীরা বললো, ঠিক আছে আমাকে ভাবতে দাও। অতপর মুগীরা চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলো যে, তাঁর বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য যে প্রচারণা চালানো যায় তা হলো তাঁকে জাদুকর বলা। তখন মুগীরা সম্মেলনে উপস্থিত লোকদের শিখিয়ে দিলো− 
“ওকাজের মেলায় আগত সমগ্র আরব জাহানের লোকদের তোমরা বলবে যে, সে একজন জাদুকর। তিনি এমন কালাম পেশ করেন যা পরিবার থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পিতা-পুত্র, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তাঁর যাদু পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি করে, সম্পর্কে ভাংগনের সৃষ্টি করে।” 


মুগীরার উক্ত প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হলো। ওকাজের মেলার সময় উপস্থিত হলো। মেলার কমিটির সদস্যরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে রাসূল সা: -কে জাদুকর বলে প্রচার করলো এবং তাঁর যাদুর ফলে কী কী হয় তা মেলায় আগত জনগণের কাছে বলতে থাকলো। তারা মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে আগে থেকেই জনতাকে সতর্ক করে দিলো। এই ঘটনার ফলাফল যা হলো তাতে, কুরাইশরা রাসূল সা: -এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে যেয়ে উপরন্তু রাসূল সা: -এর নাম সমগ্র আরব দেশে ছড়িয়ে দিলো। বিরুদ্ধতার প্রচ- ঝড়ের মধ্যেও আল্লাহ্র বাণী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেলো।

চলবে...