কোরআন নাযিলের ইতিহাস-৭: রাসূল সা: রক্তাক্ত হলেন

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ১৭:২৩ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪১২ বার।

এক সময় নবী করীম সা: তায়েফ যাত্রার সংকল্প গ্রহণ করলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো সেখানকার বনু সকীফ গোত্রের লোকদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাবেন। তারা যদি ইসলাম গ্রহণ নাও করে, তবু অন্তত: তাদের কাছে নির্বিঘ্নে থেকে তাঁকে দ্বীন প্রচারের কাজ করার সুযোগ দিতে তারা রাজী হবে বলে তিনি আশা করেছিলেন। নবুয়তের দশম বর্ষের (৬১৯ খৃষ্টাব্দ) শাওয়াল মাসের প্রথম দিকে নবী করীম সা: তায়েফ নগরে গমন করেন। তায়েফ মক্কা থেকে অনেক দূের অবস্থিত ছিল। তিনি পায়ে হেঁটে তায়েফে গিয়েছিলেন এবং ফিরে এসেছেন। তিনি কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা করতে পারেন নাই। এ সময় তাঁর সাথে মুক্ত করা ক্রীতদাস হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা রা: ছিলেন। তায়েফ যাওয়ার পথে রাসূল সা: যে গোত্রের কাছ দিয়েই অতিক্রম করতেন, সে গোত্রের লোকদেরই ইসলামের দাওয়াত দিতেন। কিন্তু কেউই তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেনি। তায়েফে পৌঁছে তিনি ছাকিফ গোত্রের তিন সর্দারের কাছে যান। তারা ছিল পরস্পর ভাই ভাই। রাসূল সা: তাদের কাছে পৌঁছে তাদেরকে আল্লাহ্র আনুগত্য এবং ইসলামের সাহায্য করার আহ্বান জানান। জবাবে তাদের একজন টিপ্পনি কেটে বললো-সে কাবার পর্দা ছিড়ুক যদি আল্লাহ্ তাকে রাসূল করে থাকেন। (অর্থাৎ তোমার মতো লোকের নবী হওয়া অসম্ভব, যেমন কাবা ঘরের পর্দার ওপর হামলা অসম্ভব। আবার এ অর্থে যে- যদি তুমি নবী হও, তবে আল্লাহ্ আমাকে ধ্বংস করুন)। অন্য একজন বললো- আল্লাহ্তায়ালা কি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে পেলেন না? তৃতীয়জন বললো- আমি তোমার সাথে কোনো কথাই বলতে চাই না। কেননা তুমি যদি নবী হয়ে থাকো তোমার কথা প্রত্যাখ্যান করা আমার জন্য অত্যন্ত বিপদজনক হবে। আর তুমি যদি আল্লাহ্র নামে মিথ্যা কথা রটাও, তবে তো তোমার সাথে আমার কথাই বলা উচিত নয়। এসব শুনে রাসূল সা: উঠে দাঁড়ান। তিনি শুধু এতটুকুই বললেন: “তোমরা যা করেছো তো করেছো, তবে বিষয়টা গোপন রাখো। 
রাসূল সা: তায়েফে দশ দিন অবস্থান করেন। এসময় তিনি এক এক করে তায়েফের প্রত্যেক নেতৃস্থানীয় লোকের কাছে যান এবং তাদের সাথে কথা বলেন। কিন্তু তায়েফের কোনো বড় বড় পুরোহিত, গোত্রপতি, পণ্ডিতবর্গ তাঁর কথায় কান দিলো না। তাদের সবারই একই জবাব: তুমি এই শহর থেকে বের হয়ে যাও। শুধু একথা বলেই তারা ক্ষান্ত হলো না। বরং তারা বখাটে-গুন্ডা, উচ্ছৃঙ্খল ছেলেদের লেলিয়ে দিলো। রাসূল সা: যখন ফিরতে উদ্যত হলেন তখনই দুর্বৃত্তরা তাঁকে গালি ও হাত তালি বাজাতে লাগলো। নেতাদের উষ্কানিতে যুবকেরা তাঁর পেছনে পেছনে চলতে লাগলো। সময় গড়ার সাথে সাথে রাস্তার দুপাশে ভিড় জমে যায়। মনে হয় যেন উৎসুক জনতা একজন পাগলকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করছে। এভাবে রাসূল সা:-এর পথের দুপাশের রাস্তায় দুর্বৃত্ত জনতার সারি পড়ে যায়। এরপর তারা রাসূলকে গালা-গাল করতে থাকে এবং পাথর ছুঁড়তে থাকে। হুজুর সা: -এর পবিত্র দেহ পাথরের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে যায়। সারা শরীরে রক্তের স্রোত বইতে থাকে। দেহ থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়ে গোঁড়ালি বেয়ে তাঁর জুতা রক্তে ভিজে যায়। ওদিকে যায়দ ইবনে হারেসা রা: ঢাল হিসাবে প্রিয় রাসূলকে আগলে রাখছিলেন। ফলে মাস্তানদের নিক্ষিপ্ত পাথর তাঁর গায়ে পড়েছিলো। এতে তাঁর মাথায় কয়েক জায়গায় আঘাত লাগে। বদমাশ দুর্বৃত্তদের হামলার এই ধারা অব্যাহত থাকে। একসময় আল্লাহ্র প্রিয় রাসূল বিশ্বনবী মোস্তফা সা: অসহায়-নিরুপায় অবস্থায় একটি বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হোন। যাদের জন্য তিনি মুক্তির পয়গাম নিয়ে গেলেন তাঁরাই তাঁকে বর্বর-নির্মমভাবে প্রস্তরাঘাতে জর্জরিত করলো। 
ঐ বাগান তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত ছিলো। রাসূল সা: ঐ বাগানে আশ্রয় নেয়ার পর গুন্ডাবাহিনী হামলা বন্ধ করে ফিরে যায়। রাসূল সা: এক দেয়ালে হেলান দিয়ে আংগুর গাছের ছায়ায় বসে পড়েন। অবস্থা কিছুটা শান্ত হওয়ার পর আহত নবী সা: তায়েফবাসীর নিষ্ঠুর আচরণে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তাঁর আহ্বানে লোকদের ঈমান না আনায় তাঁর মন দুঃখের সাগরে ভাসতে থাকে। দুঃখ ভারাক্রান্ত নবীজি সা: আল্লাহ্র দরবারে করুণ-বিনীত ফরিয়াদ জানান- তিনি কাতর কন্ঠে বললেন: 
“হে আল্লাহ্তায়ালা! আমি তোমার কাছে আমার অসহায়ত্ব, দুর্বলতা এবং আমার প্রতি লোকদের অসম্মান ও অপমানের অভিযোগ করছি। তুমি দয়ালু দাতা, দুর্বলদের রব্ব। তুমি আমারও রব্ব। তুমি আমাকে কার কাছে ন্যস্ত করেছো? এমন লোকদের কাছে কি আমাকে ন্যস্ত করেছো যারা আমার সংগে নির্মম, কঠোর ও রূঢ় আচরণ করবে? কিংবা এমন কোনো শত্রুর হাতে আমাকে ছেড়ে দিচ্ছো যে আমাকে পরাস্ত করে ছাড়বে? যদি তুমি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হও তবে আমার কোনো দুঃখ নেই; আফসোসও নেই। হে রব্ব! তুমি যদি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট না হয়ে থাকো, তাহলে আমি কোনো বিপদকেই ভয় করিনা! তবে তোমার কাছ থেকে যদি নিরাপত্তা পাই, তাহলে আমি অধিক প্রশস্ততা লাভ করতে পারবো। আমি তোমার কাছে সেই নূর-এর আশ্রয় চাইছি যা অন্ধকারকে আলোকিত করে দেবে এবং ইহকাল ও পরকালের সব ব্যাপারই সঠিক করে দিবে। আমার ওপরে তোমার গযব নাযিল থেকে আমাকে তুমি রক্ষা করো। আমি যেন তোমার ক্রোধ ও অসন্তোষের পাত্র না হই। তোমার সন্তোসেই আমি সন্তুষ্ট, তুমি যেন আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকো। তুমি ছাড়া কোথাও শক্তি বা জোর বলতে কিছুই নাই।” -এই দোয়াকেই “দোয়ায়ে মোসতাদয়াফীন” বা দুর্বলদের দোয়া বলা হয়।

চলবে...