তিতল

অসীম কুমার কৌশিকঃ
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৩:৫৩ ।
শিল্প ও সাহিত্য
পঠিত হয়েছে ৬০৯ বার।

দৌড় দে বাজান বৃষ্টি নামবে । বলতে বলতেই দুই বাপ বেটা কাকভেজা হয়ে রাস্তার পাশে ছাউনিতে দাঁড়ালো।দুহাতে বৃষ্টির স্পর্শ নিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো ১৫ বছরের তিতল।প্রাথমিক শাখার বেশি তার ভাগ্যে লেখাপড়া জোটেনি।বাঁচার তাগিদে তাইতো দুই বাপ বেটা হাত ধরে শহরে এসেছে।কান্না দেখে সামন্ত ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বলছে কি হইছে তিতল কাঁদছিস কেনো?আমার যে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাবা।বৃষ্টির স্পর্শে মাটির সেই ধূলোমাখা গন্ধ কোথায় হারিয়ে গেলো,কোথায় গেলো সেই কাদামাখা পথ।এখানে যে মাটিকে চাপা দিয়ে বৃষ্টির পরশ থেকে আলাদা করেছে বাবা।ছেলের এমন তীক্ষ্ণ প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে না পেরে মুখ ফিরিয়ে দুচোখের অশ্রু লুকাচ্ছে সামন্ত।

ছেলেবেলা থেকেই তিতল প্রকৃতিপ্রেমি। জন্মের সময় মাকে হারিয়ে প্রকৃতিকেই যেনো মা এর জায়গায় বসিয়েছে।তাইতো প্রকৃতির স্পর্শ,গন্ধ তার এতো চেনা।উঠানে দাঁড়াতেই পুরোনো কিছু কথা নাড়া দিয়ে উঠলো সামন্তের মনে।সেই ছেলেবেলায় এসেছিলো পিসিমার বাড়িতে।তারপর সময়ের সাথে সাথে যেনো সম্পর্কের দূরত্বটা বেড়েই চলেছিল।পিসিমার বড় অাদূরে ছিলো সামন্ত।বেশিদূর লেখাপড়া তার ভাগ্যেও জোটেনি।স্কুল জীবন শেষ করার অাগেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল তাকে।সেবার পিসিমার বাড়িতে অাসার পর সে কি ভীষণ জ্বরে পড়েছিল সামন্ত।সারারাত তার পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিয়েছিল পিসিমা।তারপর সেই যে গেলো অার অাসেনি পিসিমার বাড়িতে।কিন্তু অাজ সে এসেছে,সমস্ত দূরত্ব অতিক্রম করে।তিতলের জন্মের সময় সমস্ত ভীটেমাটি বিক্রি করে পাওয়া সব টাকা শেষ হলেও তিতলের মাকে বাঁচাতে পারেনি।দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলো সামন্ত।সঙ্গে সঙ্গে দুচোখ বেয়ে অশ্রু নামলো।

সেগুলো দুহাতে মুছে পিসিমাকে প্রণাম করলো সে।এমন অদ্ভুত কান্ডে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রিতাবালা।তিনি সামন্তকে চিনতে না পেরে বললেন কে তুমি?অবশ্য এমন প্রশ্নে হতবাক হন নি সামন্ত।কেননা সেই ছেলেবেলার পর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না পিসিমার সাথে।আমি সামন্ত গো পিসিমা, তোমার সেই সামন্ত।রিতাবালা একটু এগিয়ে এসে নিরীক্ষার দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সামন্তকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো।বহুদিনের জমে থাকা ভালবাসা আজ অশ্রু হয়ে নামলো।এই দেখো আমার ছেলে তিতল।কপালে চুমু খেয়ে বলল ওরে আমার মানিক এই বুড়িটার কথা এতোদিনে মনে পড়লো।তিতল কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে আছে।এমা তোরা তো ভিজে গেছিস আর আমি বকবক করে যাচ্ছি।আয় ভেতরে আয়।তারপর সব গল্প হবে।ঘুম থেকে উঠে তিতল দেখলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে।এসে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো ওরা।কই আমার নাতিটার ঘুম ভাঙলো। উঠে বসল সামন্ত অার তিতল।মোটে দুইটা ঘড় থাকার। আর রান্নাঘর উঠোনের অন্যপাশে।বাড়িটাও বেশ পুরোনো হয়ে গেছে।সামন্তের সব কথা শুনে পিসিমা চোখ মুছতে মুছতে বলল,তোরা এখানে থাকবি সে তো ভালো কথা।আমি একা থাকি,সামনের ওই একখন্ড জমি থেকে যা পাই তাই দিয়ে কোনোরকম চলে।ক দিন ই বা বাঁচবো আর।তোর পিসে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো।তারপর ছেলেটা সেই যে জ্বরে পড়লো আর উঠলো না।এই ভাঙা বাড়িটাই এখন স্মৃতি হয়ে আছে। আর কিছুই নেই। 

একটা কারখানায় কাজ পেল সামন্ত।তখন থেকেই মনে মনে স্থির করলো তিতলকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দেবে।তাই তিতলকে কোনো কাজে যেতে দেয় নি।খুব সকালে বেড়িয়ে যায় সামন্ত,আসে সেই রাত ১০ টায়।কখনো কখনো এসে দেখে তিতল ঘুমিয়ে পড়েছে।কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে পিসিমার ডাকে খেতে যায় সামন্ত।প্রতিদিনের মতো সকাল হতেই বেড়িয়ে যায় সামন্ত খাবার সাথে নিয়ে।তিতল তার অনেক সঙ্গী পেয়েছে এখানে।ঠাকুমার সাথে আজ জমিতে এসে দুচোখ বুজে ফসলের ঘ্রাণ নিয়েছে সে।আর মনে পড়েছে তাদের গ্রামের সেই সবুজে ভরা মাঠের কথা।দু হাতে যেন জড়িয়ে রাখতো সেই সবুজে ভরা মাঠ।এতটাই কল্পনাবিলাসী ভালোবাসার জগত ছিল তার।এখানে খুব অল্প কয়েকটা জমি রয়েছে।যেগুলো একসময় বিলীন হয়ে যাবে।নাতির এমন কান্ড দেখে রিতাবালা হেসে উঠে বলল ওরে পাগল আয় তোকে নদীর ধারে নিয়ে যাই।তিতল দৌড়ে এলো নদীর ধারে যাওয়ার জন্য। কিন্তু নদীর ধারে এসে তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।

ঠাকুমা বলতে লাগলো এই হলো আমাদের করতোয়া নদী।তিতলের এদিকে খেয়ালই নেই ।তার মনে তখন তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে কলকল শব্দে চলা সেই বুড়িগঙ্গা নদী ভেসে উঠেছে।কি অপূর্ব ছিল তার ঘ্রাণ। এলোকেশ বিছিয়ে যেন আপন মনে বয়ে চলা এক মায়াবতী সে।হাওয়াই যখন তার ঢেউ কিনারায় আছড়ে পড়তো মনে হতো যেন এলোকেশী মায়াবতী তাকে নিয়ে বিলীন হতে চায়।তিতল তখন দুচোখ বন্ধ করে নিজেকে বিলিয়ে দিতো সেই এলোকেশী মায়াবতীর মাঝে।অকি, কি হলো তোর তিতল কাদছিস কেনো?দেখেছো ঠাকুমা কেমন বিবর্ণ করে দিয়েছে আমার এলোকেশী মায়াবতী কে।তাকে যে আমি চিনতে পারছি না।এই শহরের মানুষ গুলো এমন কেনো গো ঠাকুমা! বিবর্ণ করে দিয়েছে আমার মায়াবতীকে।তুমি যাও ঠাকুমা আমি আসছি একটু পর।বলে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো তিতল। 

হঠাৎ আকাশ মেঘে ঢেকে গেলো।তিতল উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত মেলে দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। অবশেষে বৃষ্টির পরশ পেয়ে তার এ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল।একটা ঝাঁকুনিতে সে কল্পনার জগত থেকে বেড়িয়ে এলো।সে দেখলো ঠাকুমা তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির দিকে।তিতল খেয়াল করলো আকাশের অশ্রুতে ঠাকুমার অশ্রু ঢেকে গেলেও মৃদু কান্নার শব্দ হচ্ছে।বাড়িতে এসেই তিতলের বুঝতে আর বাকি রইলো না ঠাকুমার এই কান্নার কারণ।তারপর অনেক দিন তিতলকে আর দেখা যায় নি।কয়েক বছর পর বুড়িগঙ্গার তীরে একটি ছেলেকে দেখা গেলো মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকতে।আকাশটা যেন সে দুহাতে পরম যত্নে আগলে রেখেছে।প্রকৃতির চিনতে বাকি রইলো না এই সেই তিতল।সেদিন তিতল বাড়িতে গিয়ে অচেনা এক মা কে দেখেছে। তাই আজ সে প্রকৃতিমাতার আচল ছায়ায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে।ঝুম ঝুম শব্দে মাতার আনন্দ অশ্রু তিতল কে স্পর্শ করে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো অজানার পথে।আহা কি পরম সে অনুভব।