কোরআন নাযিলের ইতিহাস-১৪: রাসূল সা: যেভাবে ওহী পেতেন 

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ০৪ মে ২০১৯ ১৮:০৮ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৫৯০ বার।

রাসূলে মকবুল সা: -এর প্রতি বিভিন্নভাবে ওহী নাযিল হতো। যেমন-
(১) সত্য-স্বপ্ন যার মাধ্যমে রাসূল সা: -এর ওপর ওহী নাযিলের সূচনা হয়। সহীহ বোখারিতে এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেন- হুজুর সা: -এর প্রতি ওহী নাযিলের সূচনা হয় এক সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। এরপর থেকেই তার মধ্যে নির্জনে ইবাদত করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এসময় তিনি হেরা গুহায় রাতের পর রাত কাটাতে থাকেন। এ অবস্থাতেই এক রাতে আল্লাহর ফেরেস্তা আসেন এবং তাঁর ওপর ওহী নাযিল হয়। 


(২) ফেরেস্তা তাঁকে দেখা না দিয়ে তাঁর মনের মধ্যে কথা প্রক্ষেপ করতেন। ফলে রাসূল সা: -এর অন্তরে ওহী গেঁথে যেত। 


(৩) ফেরেস্তা মানুষের আকৃতি বেশে রাসূল সা: -কে সম্বোধন করতেন এবং ওহী পৌঁছে দিতেন। ফেরেস্তা যা কিছু বলতেন রাসূল সা: তা মুখস্থ করে নিতেন। এ সময় কখনো কখনো সাহাবীকেরামগণ মানুষবেশী ফেরেস্তাকে দেখতে পেতেন। এই অবস্থায় হযরত জীবরাঈল আ: -কে সাধারণত প্রখ্যাত সাহাবী হযরত দাহিয়া কালবী রা: -এর আকৃতিতে দেখা যেত। মানুষের রূপ ধরে ফেরেস্তার আগমনী ওহী নাযিল পদ্ধতিই রাসূল সা: -এর নিকট সবচেয়ে সহজ মনে হতো। 


(৪) রাসূল সা: -এর নিকট ঘণ্টা ধ্বনির ন্যায় টন টন শব্দে ওহী আসতো। এ অবস্থায় ফেরেস্তা তাঁর সাথে দেখা করতেন। প্রচ- শীত মৌসুমেও তাঁর শরীর থেকে ঘাম ঝড়ে পড়তো। তিনি উটের ওপর চড়ে থাকলে উট মাটিতে বসে পড়তো। একবার রাসূল সা: হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রা: -এর উরুর উপর মাথা রেখে শুয়ে ছিলেন। এ অবস্থায় ওহী আসলে যায়েদ রা: তীব্রভার অনুভব করেন যেন তার উরু থেতলে যাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে ওহীর আগমন রাসূল সা: -এর নিকট খুব কষ্টকর ছিলো। এ পদ্ধতিতে নাযিল হওয়া ওহীর হালকা মৃদু আওয়াজ কোনো কোনো সময় সাহাবীদের কানেও পৌঁছাতো। হযরত ওমর রা: বর্ণনা করেন “কোনো কোনো সময় ওহী নাযিল হওয়া অবস্থায় রাসূল সা: -এর পবিত্র মুখম-লের চারদিক মৌমাছির গুঞ্জণের ন্যায় গুণ গুণ শব্দ শোনা যেত। 


ঘণ্টার ধ্বনির ন্যায় আওয়াজের তুলনা হলো, বিরতিহীনভাবে ঘণ্টা বাজালে সেটার আওয়াজ কোন্ দিক থেকে আসছে তা নির্ণয় করা যায় না। তখন মনে হয় চারদিক থেকেই আওয়াজ আসছে। তাই সাধারণ মানুষের জন্য বোধগম্য করার উদ্দেশ্যেই ওহী নাযিলের পবিত্র আওয়াজকে ঘণ্টা ধ্বনির সাথে তুলনা করা হয়েছে। 


হযরত আয়েশা রা: -এর বর্ণনা মতে, আওয়াজ সহকারে ওহী নাযিল শেষ হওয়ার পর প্রচণ্ড শীতের মধ্যে রাসূল সা: -এর কপাল ঘর্মাক্ত হয়ে যেত, তাঁর শ্বাস প্রশ্বাস ফুলে উঠতো, পবিত্র চেহারা শুকনা খেজুর পাতার ন্যায় ধূসর হতো। একদিকে ঠা-ায় তার সামনের দাঁত ঠোকাঠুকি করতো অন্যদিকে শরীরে মুক্তার মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যেতো। 


(৫) তিনি ফেরেস্তাকে তার প্রকৃত চেহারায় দেখতেন। সে অবস্থায়ই আল্লাহ্র ইচ্ছায় ওহী নাযিল হয়েছিল। এরূপ দুবার হয়েছিল। কোরআনে সূরা নাজমে আল্লাহ্তায়ালা যার উল্লেখ করেছেন এভাবে- 
“শপথ তারকা রাজির যখন তা অস্তমিত হলো। তোমাদের সংগী না পথ ভ্রষ্ট হয়েছে, না বিভ্রান্ত। সে নিজের মনের ইচ্ছায় কথা বলে না। এটি তো একটা ওহী, যা তাঁর প্রতি নাযিল করা হয়। তাঁকে এক মহাশক্তিধর শিক্ষা দিয়েছে, যে বড়ই কুশলী। সে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যখন সে উচ্চতর দিগন্তে অবস্থিত ছিলো। পরে কাছে এলো এবং উপরে শূন্যে ঝুলে থাকলো। এমনকি, দুই ধনুকের সমান কিংবা তা থেকে কিছুটা কম দূরত্ব থেকে গেলো। তখন সে আল্লাহ্র বান্দাকে ওহী পৌঁছালো যে ওহীই তাঁকে পৌঁছাবার ছিলো। দৃষ্টি যা কিছু দেখলো, হৃদয় তাতে মিথ্যা সংমিশ্রণ করেনি। এখন তোমরা কি সেই ব্যাপারে তাঁর সংগে ঝগড়া করো যা সে নিজের চোখে দেখেছে? আর একবার সে সিদরাতুল-মুনতাহার কাছে তাঁকে দেখেছে।”-সূরা নাজম: ১-১৪
[“মহাশক্তিধর” বলতে হযরত জিবরাইল আ: -কে বুঝনো হয়েছে। রাসূল সা: হযরত জিবরাইল আ: -কে প্রথম বার দেখেন উচ্চ দিগন্তে। আর দ্বিতীয় বার দেখেন সিদরাতুল-মুনতাহায় অর্থাৎ মেরাজের রাত্রিতে।]


(৬) এই পদ্ধতিতে কোনো মাধ্যম ছাড়া অর্থাৎ ফেরেস্তা ছাড়াই সরাসরি আল্লাহ্র সঙ্গে বাক্যালাপের মাধ্যমে ওহী নাযিল হওয়া। এই বিশেষ মর্যাদা হুজুর সা: জাগ্রত অবস্থায় মাত্র একবার মিরাজের রাত্রিতে পেয়েছিলেন। আর অন্য একবার স্বপ্নযোগেও তিনি আল্লাহ্র সাথে কথা বলেছিলেন। এ প্রকারের ওহীর প্রমাণ কোরআন মজিদের পরিবর্তে মেরাজের হাদিসে রয়েছে। 


[কোরআন নাযিলের ইতিহাস বিষয়ক আলোচনা ১৪ পর্বে আপাতত সমাপ্ত হলো, পরবর্তীতে এই একই বিষয়ে আরো লেখা থাকবে, ইনশাল্লাহ্। তবে আগামীকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘কোরআনের কিছু কথা’ বিষয়ক আলোচনা, চোখ রাখুন।]