২২ বৈশাখ ওফাত দিবস

শাহ্ সুফী ফতেহ আলী (রহ.) যে কারণে বগুড়ায় থেকে গেলেন

আব্দুর রহিম বগরা
প্রকাশ: ০৫ মে ২০১৯ ১১:৪২ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১২৯৫ বার।

[ইসলাম ধর্মের মহান সাধক শাহ্ সুফী ফতেহ্ আলী আস্কালীর (রহ.) ওফাত দিবস ২২ বৈশাখ (৫ মে)। এদিন বগুড়া শহরে তাঁর মাজার প্রাঙ্গণে ওরসের আয়োজন করা হয়েছে। মহান এই সাধকের বগুড়ায় আগমন, ধর্ম প্রচার এবং এই শহরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরেছেন সাংবাদিক ও গবেষক আব্দুর রহিম বগরা। লেখাটি তাঁর ‘হযরত শাহ্ সুফী ফতেহ্ আলী (রহ.)-এর জীবন কথা’ থেকে নেওয়া হয়েছে।-সম্পাদক] 

মহান সাধক হযরত শাহ্ সুফী ফতেহ আলীর (রহ.) জন্ম ১৬৮৪ খৃস্টাব্দে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের আস্কালে। তার নামের শেষে জন্মস্থানের নাম যুক্ত করে লেখা হয় হযরত শাহ্ সুফী ফতেহ আলী আস্কালী (রহ.)। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ হোসেন, মাতার নাম হামজা বেগম।  
পুত্র ফতেহ আলীকে নিয়ে বাবা-মা’র অনেক স্বপ্ন। তাকে গ্রামের মক্তবে ভর্তি কওে দেওয়অ হয়। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করলে তাকে সমন্দর নামক স্থানের এক বিখ্যাত মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। কিন্তু সেখানকার পাঠ শেষ হলে ফতেহ আলীর জ্ঞান পিপাসা থেকেই যায়। পুত্রের এই হালত দেখে পিতা মোহাম্মদ হোসেন তাকে শাহাবল নামক জায়গায় অবস্থিত আরেক উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হলে বাবা-মা তাকে বিয়ে করালেও তিনি সংসার ধর্মে মনোযোগী হননি।
পরে ফতেহ আলী পাঞ্জাবের এক সওদাগর কাফেলার সাথে চীন দেশে যান। দেখা যায়, এই সময় থেকে শুরু হয় তার মুসাফির জীবন। আঠারো বছর পর তিনি ভারত বর্ষে ফিরে এলেও গৃহমুখী হয়েছিলেন কি না, সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না।
চীন থেকে ভারত বর্ষে ফিরে তিনি আজমীরে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি’র (রহ.) মাজার শরীফে অবস্থান করেন। এক সময় আজমির শহরের ধন্যাঢ্য বণিক গোপাল সাহার ঘোড়ার সহিস বা তত্ত্বাবধায়কের চাকুরি করেন। তার মুসাফির জীবনের ১২ বছর কেটেছে আজমীর শরীফে। তারপর তাকে দেখা যায় বগজ শহরে। এখানে তার মুসাফির জীবনে নেমে আসে অনেক কষ্ট। সেখানকার আবহাওয়া ও পরিবেশ তার স্বাস্থ্যের উপযোগী ছিল না। ফলে তিনি নানা রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত হন। পাঁচ বছর পর বগজ ছেড়ে তিনি চলে যান শিস্থানে। সেখানেও স্থায়ী হযনি এই মুসাফিরের জীবন মঞ্জিল। স্থায়ীত্বের আশায় ছুটেছেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়।
শিস্থানে বসবাসের সময় ফতেহ আলী জানতে পারেন উত্তরবঙ্গেও বালিয়া খানকার কথা। সেটা তখন ছিল বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ থানা এলাকায়। যা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত। আমরা দেখি সেখানে তার জীবনের পরবর্তী মঞ্জিল ঠিক হয়। সুদূর শিস্থান থেকে বালিয়া খানকায় পৌঁছুলে সেখানকার কর্তৃপক্ষ তাকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে গ্রহণ করেন। তার মত কামালিয়াত হাছিল করা একজন বুজুর্গের অপেক্ষায় ছিলেন যেন তারা। হযরত শাহ্ ফতেহ আলীকে (রহ.) পেয়ে বালিয়া খানকা পরিপূর্ণতা লাভ করে। এখানেই কাটে তার জীবনের একুশটি বছর। হয়ত তার আশা ছিল দুনিয়ার জিন্দেগী বালিয়া খানকাতেই কাটিয়ে যাবে। কিন্তু না, ভাগ্যে তা হয়নি। ফের শুরু হয় তার নতুন মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে পদযাত্রা। কেন তাকে বালিয়া খানকা শরীফ ছাড়তে হলো? তা ছিল বড় দুর্ভাগ্যের কথা। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে শাসনের চাকুব। যুগ যুগ থেকে মুসলমানদের অধিকারে থাকা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও আচার অনুষ্ঠানের স্থানগুলো পরিচালনায় যে সমস্ত লাখেরাজ ( মোঘল সম্রাটদের দান করা জমি যা ছিল খাজনা মুক্ত) আয়মা, ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আইন করে বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করে। সেই বাজেয়াপ্ত আইনের কোপ পড়ে বালিয়া খানকা শরীফের উপর। এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে অতীত বাংলার মোগল সুবেদার শাহ্ সুজার (সম্রাট শাজাহানের পুত্র) সনদমূলে প্রদত্ত লক্ষাধিক বিঘা লাখেরাজ জমি বাজেয়াপ্ত করে কোম্পানি তাদের এখতিয়ারে নিলে বালিয়া খানকার ‘তালীম ও তারবিয়ত’ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। সম্পদ ও আয়ের উৎস বাজেয়াপ্ত করার ফলে সেখানে কর্মরত মোহাদ্দেছ, মুফতী, ফকিহ, আলীম ও পীর-বুজুর্গশ্রেণির মানুষ উপায়হীন হয়ে পড়েন।
এই পরিস্থিতিতে হযরত শাহ্ সুফী ফতেহ আলী (রহ.) তার কয়েকজন সাগরেদসহ নতুন মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে পদযাত্রা শুরু করেন। এবার পথ তাকে নিয়ে আসে হযরত শাহ্্ সুলতান মাহী সাওয়ার বলখী (রহ.) এর দরগা মহাস্থানে। এই দরগার নামে ২ সহস্রাধিক বিঘা জমি লাখেরাজ ছিল বলে তার আয় থেকে সেখানে আগত মুসাফির, মিসকিন, জিয়ারতকারীদের ছিন্নি ও অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা হত।
হযরত শাহ্ সুফী ফতেহ আলী (রহ.) মহাস্থানে দরগায় পৌঁছে জানতে পারেন ইংরেজদের বাজেয়াপ্তের খগড় সেখানেও পড়েছে। মহাস্থানে লাখেরাজ জমির কৃষক প্রজাদের মধ্যে তখন হাহাকার অবস্থা চলছে। তারা উপায় খুঁজে ফিরে। তাদের পাশে এসে দাঁড়ান তখন ফকির মজনু শাহ, যিনি ফকির বিদ্রোহের সিপাহসালার। মহাস্থানগড়ে তার শক্ত ঘাঁটি। ইংরেজ বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলা সম্ভব হয়নি। ইতিহাস বলে, মহাস্থানে ফকির বাহিনীর মোকাবেলায় ইংরেজ বাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ব্রেনানের নিহত হবার কথা।
সেই সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি এড়িয়ে হযরত শাহ্ সুফী ফতেহ আলীর (রহ.) জীবনের শেষ মঞ্জিলের ঠিকানা হয় মহাস্থানগড়ের ৮ মাইল দক্ষিণে করতোয়া নদীর পাড়ে, যেখানে আজ তার মাজার শরীফ অবস্থিত। তখন ছিল তা বিরাট আমবাগানের ছায়া বিছানো এক মনোরম স্থান। জায়গাটায় পৌঁছে হযরত শাহ্্ সুফী ফতেহ আলীর (রহ.) মিল খুঁজে পান স্বপ্নে দেখা তাঁর এক বাগানের প্রতিচ্ছবির। খোঁজ খবর করে তিনি জানলেন জায়গাটার মালিক শেলবর্ষ পরগনার জমিদার কুদ্দুগ্রামের আতা চৌধুরী। জনকোলাহল মুক্ত নিরিবিলি জায়গা। নদীর পশ্চিম পাড় বেশ উঁচু, পূর্ব পাশে পলিমাটির বুক চিরে বয়ে চলা খরস্রোতা করতোয়া নদী। নদীস্নাত নির্মল বাতাস দেহ মনের জন্য যেন প্রকৃতির আদর। সাধক মনে নিয়ে আসে তন্ময়তা। হযরত শাহ্ সুফী ফতেহ আলী (রহ.) কাশ্ফ শক্তিতে জানতে পারেন, এই জায়গাটাই হবে তার জিন্দেগীর শেষ মঞ্জিল। খানকা তৈরির অনুমোদনের জন্য তার সাগরেদরা শেলবর্ষ পরগনার জমিদার আতা চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি হযরত শাহ্্ সুফী ফতেহ আলীর (রহ.) নাম শুনে সেখানে খানকা প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। এরপর চারদিকে ছড়িয়ে পরে হযরত শাহ্ সুফী ফতেহ্ আলীর (রহ.) বুজুর্গীর কথা। তখন শহরতো নয়ই, জেলা হিসেবেও ‘বগুড়া’ গঠিত হয়নি। মুর্শিদাবাদ নবাবের ও স্থানীয় শেলবর্ষ পরগনার জমিদারদের সেরেস্তা, কাছারি ছিল পুরান বগুড়া গ্রামে। সেখানেই ছিল ‘বগরা’ নামে থানা।
১৮২১ সালে রাজশাহী জেলা থেকে বগরা থানা কেটে যখন স্বতন্ত্র জেলা গঠন করা হয় তখন ওই থানার নামে বগ্রা জেলার নামকরণ করা হয়। আর পুরান বগুড়া গ্রাম থেকে স্থানান্তর করা হয় অতীতে ও সেই থানা ভবন। আমরা দেখি হযরত শাহ্্ ফতেহ্ আলীর (রহ.) ওফাতের ৪৫ বছর পর বগুড়া জেলা গঠিত হয় এবং দিনে দিনে তার খানকা ও মাজারকে কেন্দ্র করে এই বগুড়া শহর গড়ে উঠতে থাকে। এই মহান সাধক পুরুষের বগুড়ায় আগমনকাল ১৭৫৯ সাললে। বগুড়ায় ১৮ বছর অবস্থানের পর তার ওফাত ১৭৭৭ সালে।
বগুড়ার মুসলিম সমাজতো বটেই হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে তার নাম ভক্তি শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে স্মরণ করে থাকেন। অর্থাৎ তিনি বগুড়ার মানুষের ধর্মীয় সম্প্রীতির অংশ বলে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে তাঁর দরগায় ভক্তি প্রদর্শন করতে দেখা যায়।
তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা আলোচনা করে মানুষ গৌরব বোধ করেন। সে সময় করতোয়া নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা বাজারের কোন দোকানে তিনি প্রবেশ করেছেন বা দোকানের কোন জিনিস হাত দিয়ে তুলেছেন বা নেড়ে-চেড়ে দেখেছেন, সেদিন সেই দোকানে বেশি বেচা-কেনা হতো। আর দোকানিরা ফতেহ আলীর (রহ.) খানকা থেকে বের হবার অপেক্ষায় থাকতেন। 
সুত্রাপুর, কাটনারপাড়া, বৃন্দাবনপাড়া, ফুলবাড়ি গ্রামের বিভিন্ন মহল্লায় তার যাতায়াত ছিল। ওই সব গ্রামের অনেকে তার মুরিদ ছিলেন। সুত্রাপুর গ্রামের মরহুম বশারত উল্লাহ্ ফকিরের চাচা মরহুম আমিরুল্লাহ্্ ফকিরের পিতা মরহুম মুছা ফকির হযরত শাহ্ সুফী ফতেহ্ আলীর (রহ.) মুরিদ ছিলেন।
একই গ্রামের মরহুম মোতারফ আলী খান [বগুড়া মিউনিটিসিপ্যালিটির (বর্তমানে পৌরসভা) কমিশনার] পূর্ব পুরুষ হযরত ফতেহ্ আলীর সান্নিধ্যলাভ করেছেন এবং তার মুরিদ ছিলেন। বৃন্দাবন পাড়ার প্রসিদ্ধ মুসলিম পরিবারের অনেকের বাড়িতে এই আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষের যাতায়াত ছিল। মোঃ সামছুদ্দিন ও আব্দুর রশিদের (তাঁরা টিএন্ডটি অফিসে চাকরি করতেন) পূর্ব পুরুষদের সময় হযরত ফতেহ আলী (রহ.) তাঁর মেসওয়াক করা আমগাছের ডাল বাড়ির খুলিতে পুঁতে দিলে তা এক বিরাট ফলবান বৃক্ষে পরিণত হয়। যে বৃক্ষের একেক ডালের আমের স্বাদ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। সেই বৃক্ষ যারা দেখেছেন ও আম খেয়েছেন তাদের অনেকের সাথে আমার কথা হয়েছে। তাদের সবাই দীর্ঘ হায়াতের মানুষ ছিলেন। বৃন্দাবনপাড়ায় মরহুম পীর বেলায়েত আলীর পূর্ব পুরুষদের বংশে কোন পুত্র সন্তান ছিল না। ওই বংশের পরবর্তী প্রজন্ম ও এলাকার প্রবীণদের মধ্যে  প্রচলিত ছিল যে, হযরত শাহ্্ সুফী ফতেহ আলীর (রহ.) খাস দোয়ায় ওই বংশে পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। সেই বংশধারা থেকে পরবর্তীতে জন্ম নেয় কামেল পীর বেলায়েত আলী, কেরামত আলী ও অনেক দ্বীনদার মানুষ। তৎকালীণ আরও অনেক পরিবারের বিশিষ্টজনরা তার মুরীদ ছিলেন।
বিশেষ করে কুন্দুগ্রামের মুসলিম জমিদাররা তার ভক্ত ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাদের অর্থায়নে তার খানকার পাকাঘর ও খানকা বরাবর করতোয়া নদীর পাড়ে প্রশস্থ ঘাট নির্মাণ করা হয়। যে ঘাটের নাম ছিল ‘পীর ফতেহ আলী বাবার ঘাট’। ওই ঘাট নির্মাণের সাথে জড়িয়ে আছে কুন্দুগ্রামের জমিদার সৈয়দ আকবর চৌধুরী ও তার কন্যা সৈয়দা লতিফাতুন্নেছার নাম। বগুড়া কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠায় রয়েছে ওই দুইজনের অবদান। তাদের থেকেই চলে এসেছে বগুড়া নবাব পরিবারের বংশধররা।