নার্স তানিয়া ধর্ষণ ও হত্যা

বিমানবন্দর থেকেই টার্গেট করা হয়

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ মে ২০১৯ ০৬:৫০ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১২১ বার।

ভয়ঙ্কর বিপদ আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়া। তাই গন্তব্যে পৌঁছার আগেই মালপত্র গুছিয়ে বাস থেকে নামতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসের চালক নুরুজ্জামান নুরু ও হেলপার লালন মিয়া এবং তাদের এক সহযোগী তানিয়াকে নামতে দেয়নি। এ সময় চালক বলে, 'আপা, গন্তব্যে যেতে আপনার আরও সময় লাগবে। আপনি বসে থাকুন।' এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাসের ভেতরেই তিন হায়েনা ঝাঁপিয়ে পড়ে তানিয়ার ওপর। গ্রামে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে ফিরতে ঢাকা থেকে রওনা করা তানিয়াকে গণধর্ষণের পর বাসের দরজা দিয়ে নিচে ফেলে দুর্ঘটনার নাটক সাজায় তিন পাষণ্ড। রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালের নার্স তানিয়াকে গণধর্ষণের পর হত্যায় গতকাল শুক্রবার এমন লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে চালক নুরু ও হেলপার লালন। পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে চালক, হেলপারসহ পাঁচজনকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করছে বাজিতপুর থানা পুলিশ। খবর সমকাল অনলাইন 

তদন্তের এই পর্যায়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, গণধর্ষণের পরই তানিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে শুরু থেকে চালক ও হেলপার দাবি করে আসছিল- বাসটি বিলপাড় গজারিয়া এলাকায় যাওয়ামাত্র কোনো যাত্রী না দেখে মেয়েটি ভয় পেয়ে চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসা দিতে নিয়ে যায় চালক, হেলপার ও তাদের এক সহযোগী। এদিকে, গতকালই পুলিশ স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসটি জব্দ করেছে। বাসটির ভেতরে তিন জায়গায় রক্তের আলামত পাওয়া গেছে। ঘটনার পরপরই আলামত লুকাতে একই পরিবহনের অন্য একটি বাসের নাম্বার পুলিশকে জানানো হয়েছিল। সেই বাসটিও জব্দ করা হয়েছে। এখন দুটি বাসই পুলিশের জিম্মায়।

মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ জানান, তানিয়া হত্যা মামলার তদন্তে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে সব কিছু খোলাসা হবে। গণধর্ষণের পর হত্যা করে বাসচালক, হেলপার ও তাদের এক সহযোগী ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল।

বিমানবন্দর থেকেই কুদৃষ্টি: গত সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর বিমানবন্দর স্টেশন থেকে বাসটিতে ওঠার পর থেকেই তানিয়ার ওপর কুদৃষ্টি পড়ে বাসটির চালক নুরুজ্জামান নুরু ও হেলপার লালন মিয়ার। ততক্ষণে চালক ও হেলপার জেনে যায় ঢাকা থেকে পিরিজপুরগামী ওই বাসের সর্বশেষ যাত্রী তানিয়া। ৩২ যাত্রীর মধ্যে সবার পরে বাস থেকে নামবেন তিনি। বাসটি রাত ৮টার দিকে বাজিতপুরের উত্তর উজানপুরে পৌঁছলে এক মধ্যবয়সী যাত্রী নেমে পড়েন। তখন বাসটির একমাত্র যাত্রী ছিলেন কটিয়াদী উপজেলার বাহেরচরের গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে তানিয়া। বাসে তাকে একাকী পেয়ে চালক. হেলপার ও তাদের এক সহযোগী তানিয়ার দিকে কুদৃষ্টি দিতে থাকে। চালক ও হেলপারের ওই সহযোগী গাজীপুর থেকে বাসটিতে উঠেছিল। তাদের হাবভাব দেখে তানিয়ার সন্দেহ ও অজানা আশঙ্কা তৈরি হয়। তাই গন্তব্যে পৌঁছার আগেই তিনি নামতে চান। চালকসহ তিনজন বাজিতপুরের গজারিয়া এলাকায় জনৈক ফরিদ মিয়ার কলাবাগানের পাশে বাসটি থামিয়ে তানিয়ার ওপর পাশবিক নিপীড়ন চালায়। চিৎকার করলে যাতে বাইরে কেউ টের না পায় সেজন্য তারা বাসের সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। এরপর আবার ধীরে ধীরে চলতে থাকে বাসটি। এভাবেই ২০ মিনিট তানিয়ার ওপর নির্যাতন চালায় তারা। গণধর্ষণের পর তানিয়াকে মেরে ফেলা হবে নাকি জীবিত রাখবে, তা নিয়ে তিনজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় তানিয়াকে বাস থেকে ফেলে হত্যার পর সড়ক দুর্ঘটনার নাটক সাজানো হবে।

বাসে ভয়ে কাঁপছিলেন তানিয়া: তদন্ত-সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে চালক ও হেলপার জানিয়েছে, বিমানবন্দর বাসস্টেশন থেকে টার্গেট করেই তারা তানিয়াকে নির্জন জায়গায় নিয়ে ধর্ষণ করে। বাসটি কটিয়াদীতে আসার পর চালক পরিবর্তন হয়। সেখান থেকে হেলপার লালন বাসটি চালাতে থাকে। আর মূল চালক নুরু হেলপারের দায়িত্ব পালন করতে থাকে। সর্বশেষ যাত্রী হিসেবে এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি উজানপুরে নামার পর চালক, হেলপার ও তাদের সহযোগীর ভাবভঙ্গি দেখে ভয়ে বাসের মধ্যে কাঁপতে থাকেন তানিয়া। বাসের দ্বিতীয় আসনে বসা তানিয়া তার সিট থেকে উঠে পড়েন। মালপত্র গোছানোর চেষ্টা করছিলেন। এমন দৃশ্য দেখে দরজা-জানালা বন্ধ করার পর তারা তানিয়াকে বাসের মাঝামাঝি নিয়ে যায়। সেখানে ধস্তাধস্তির পর তানিয়া বাসের মেঝেতে পড়ে যান। এরপর তাকে ধর্ষণ করে তিন পাষণ্ড। বাসের হেলপার লালন মিয়া তরুণীকে হত্যা করে ঘটনাস্থলে ফেলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তবে এতে আপত্তি করে চালক নুরু। তার বক্তব্য ছিল, তানিয়াকে হত্যার পর ফেলে গেলে ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকবে। বরং তাকে বাসের দরজা থেকে ফেলে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে দুর্ঘটনার নাটক সাজাতে হবে। এর পাল্টা যুক্তি দিয়ে চালক ও হেলপারের সহযোগী বলে, দুর্ঘটনার পর মেয়েটিকে বেঁচে গেলে সব ফাঁস করে দেবে। তাই দুর্ঘটনার নাটক সাজানোর পাশাপাশি মেয়েটির মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে।

এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে চালক ও হেলপার গণধর্ষণের কথা স্বীকার করলেও মেয়েটির হত্যার ব্যাপারে দুই ধরনের ভাষ্য পাওয়া গেছে। একজন বলছে, গণধর্ষণের পর তানিয়াকে গাড়ির দরজা দিয়ে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। আরেকজনের দাবি, গণধর্ষণের পর তাকে বাস থেকে অচেতন অবস্থায় নামানোর পর পড়ে যান তানিয়া। এতে তিনি মাথায় আঘাত পান। তবে তদন্ত সংশ্নিষ্টদের বিশ্বাস, গণধর্ষণের পর তানিয়াকে ছুড়ে ফেলা রয়েছে।

বহু নাটকীয়তা, তবু ধরা : সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, দুর্ঘটনার নাটক সাজাতে মেয়েটিকে যখন রাস্তার ওপর ছুড়ে ফেলা হয়েছে তখন মোটরসাইকেল ও অন্যান্য বাসের চালক এগিয়ে যান। আহত অবস্থায় একটি মেয়ে পড়ে আছে, এটা দেখে তারা উদ্ধার করতে গেলে তিন ধর্ষক জানিয়েছিল- নামতে গিয়ে বাস থেকে মেয়েটি পড়ে গেছে। তারাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদের সাহায্যের দরকার নেই। এরপর অচেতন অবস্থায় মেয়েটিকে পিরিজপুর বাজারের সততা ফার্মেসিতে নিয়ে যায় বাসের চালক ও তার এক সহযোগী। আর হেলপার লালন পিরিজপুরে তাদের বাস কাউন্টারে গিয়ে সাজানো বক্তব্য দিয়ে বলতে থাকে- তাদের বাসের এক নারী যাত্রী রাস্তায় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তাকে সততা ফার্মেসিতে নেওয়া হয়েছে। এটা জানার পর কাউন্টার থেকে লোকজন সততা ফার্মেসিতে যান। ততক্ষণে পিরিজপুর থেকে সটকে পড়ে হেলপার লালন। সততা ফার্মেসির লোকজন মেয়েটিকে দেখে দ্রুত কটিয়াদী হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলেন। তখন বাসের চালক ও অন্যরা একটি সিএনজি অটোরিকশা ডেকে মেয়েটিকে কটিয়াদী হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করে। তবে সিএনজি অটোরিকশা চালক একজন অচেনা মেয়েকে এমন অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। তখন চালক ও তার সহযোগী গুরুতর আহত অবস্থায় মেয়েটিকে নিয়ে পিরিজপুর থেকে আবার গাজীপুরের দিকে রওনা হচ্ছিল। কিছুদূর আসার পর বাসের মালিক চালককে ফোন করে জানায়- দুর্ঘটনার শিকার মেয়েটিকে কাছাকাছি হাসপাতালে না নিয়ে আবার গাজীপুরের দিকে আনা হচ্ছে কেন। মেয়েটিকে কটিয়াদী হাসপাতালে নেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। তখনও বাসের মালিক জানতেন না, গণধর্ষণের পর তার লোকজন দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে।

একাধিক সূত্র জানায়, পিরিজপুর থেকে একটি অটোরিকশা করে স্বর্ণলতা পরিবহন কাউন্টারের লোকজন তানিয়াকে কটিয়াদী হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আর কটিয়াদী থেকে বাস নিয়ে রাতেই গাজীপুরের দিকে চলে আসে চালক নুরু ও তার এক সহযোগী। টোক নামক এলাকায় পৌঁছার পর তাদের কাছে খবর পৌঁছে মেয়েটি মারা গেছে। এরপর বাসচালক ও সহযোগী গা-ঢাকা দেয়। পরে পুলিশ প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তের মাধ্যমে তাদের গ্রেফতার করে।

পুলিশ জানায়, এখন পর্যন্ত চালক নুরু ও হেলপার লালন ছাড়া আরও তিনজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তারা হলো- বকুল মিয়া ওরফে ল্যাংড়া বকুল, রফিকুল ইসলাম ও খোকন মিয়া। তবে শেষের তিন সন্দেহভাজন ব্যক্তি গণধর্ষণের পর হত্যায় জড়িত ছিল এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা মূলত ঘটনার পর তানিয়াকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের তিনজনের দাবি- ঘটনার পর তারা বিষয়টি দুর্ঘটনা বলেই জানত।

পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোক নয়নবাজার ইউনিয়নের সালুয়াটেকি গ্রামের বাসিন্দা চালক নুরুর অতীত রেকর্ড ভালো নয়। সে নিয়মিত মাদক সেবন করত। এ ছাড়া বাসটির হেলপার লালন মিয়ার অতীত রেকর্ডও খারাপ।

তানিয়ার বড় ভাই শফিকুল ইসলাম সুজন সমকালকে বলেন, আমার বোন নার্স হিসেবে কত মানুষকে সেবা দিয়েছে। আর তাকেই কি-না মরতে হলো এমন নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে। যারা এ ঘটনায় দায়ী দ্রুত তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই।

শফিকুল জানান, ছয় ভাই-বোনের সংসারে সবার ছোট ছিল তানিয়া। তানিয়া ও আরেক ভাইকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছে পরিবার। দুই বছর হলো তারা চাকরি পেয়েছিল। এতে সংসারের সুখের মুখ দেখা শুরু হয়। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর মা মারা গেছেন। বাবার সঙ্গে প্রথম রোজায় ইফতার করতে ঢাকা থেকে ছুটিতে যাচ্ছিলেন তানিয়া। তবে বাবার সঙ্গে আর ইফতার করা হয়নি তার।