যেভাবে লাজুক যুবক থেকে ভয়াবহ আত্মঘাতী আদিল

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ মে ২০১৯ ০৬:৫৬ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ২০৯ বার।

ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ফেব্রুয়ারি মাসে আধা-সামরিক বাহিনীর বহরে ভয়াবহ এক আত্মঘাতী হামলায় প্রায় অর্ধশত জওয়ান নিহত হয়েছিলেন। এনিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিমান হামলার ঘটনাও ঘটে। 

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্য যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী ওই আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিলেন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা আদিল আহমেদ দার নামের এক যুবক।

হামলার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এতে হামলাকারী আদিল দারের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। খবর দেশ রুপান্তর 

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিডিওতে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে এত মানুষের প্রাণ নিতে যাচ্ছেন বলে আদিল দারকে এতটুকুও চিন্তিত দেখায়নি। তিনি বলছিলেন, ওই ভিডিওটা যখন প্রকাশিত হবে, ততক্ষণে তিনি জান্নাতে পৌঁছে গেছেন।

পুলওয়ামার বাসিন্দা আদিল দার ২০১৮ সালে জইশ-ই-মুহাম্মদ যোগ দেন। পুলওয়ামাতেই বড় হয়েছিলেন তিনি। আদিল আহমেদ হাইস্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। গত বছর মার্চ মাসে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছোটখাটো কাজ করতেন।

শান্তশিষ্ট আর বেশ লাজুক স্বভাবেরই ছেলে ছিলেন আদিল, এমনটাই বলছেন যারা তাকে চিনতেন।

তার পরিবার বলছে, বুরহান ওয়ানি নামের জনপ্রিয় এক স্বাধীনতাকামী নেতার মৃত্যুর পরে যে বিক্ষোভ হচ্ছিল, সেই সময়ে চোট পান আদিল দার। তারপর থেকেই ভারতের ওপরে তার ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

আদিল আহমেদ সেই হাজার হাজার কাশ্মীরী যুবকদের একজন ছিল, যাদের জন্ম হয়েছে গুলি বন্দুকের আওয়াজের মধ্যে আর জীবন শেষও হল তারই মধ্যে। ১৯৮৯ সাল থেকে চলতে থাকা হিংসাত্মক ঘটনায় কাশ্মীরে এখন পর্যন্ত ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

অনেকেই মনে করেন, ভারতের কড়া অবস্থানের কারণেই কাশ্মীর উপত্যকার অনেক যুবক অন্য পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন। এসব কড়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সর্বশেষ ছিল ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ।

বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনেও। এই সময়েই ছররা গুলি সবচেয়ে বেশি ছোড়া হয় নিরাপত্তা বাহিনীর বন্দুক থেকে। ওই গুলি লেগে শত শত মানুষের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ভারত অবশ্য ওই প্রতিবেদনটি খারিজ করে দিয়েছে।

পুলওয়ামারই বাসিন্দা ৬৮ বছর বয়সী আবদুল আহমেদ বাটের কথায়, “৯০ সালের পরে জন্ম হয়েছে যেসব কাশ্মীরীর, তাদের কপালে কখনই শান্তি জোটেনি। এদের জন্ম হয়েছে কারফিউর মধ্যে, মৃত্যুও হচ্ছে কারফিউর মধ্যেই।”

গত ২০০০ সাল থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ ধীরে ধীরে কমছিল। কিন্তু ২০১৬ থেকে বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর আবারও পুরোদমে শুরু হয়ে যায় তাদের রমরমা।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ১৫০ সন্দেহভাজন স্বাধীনতাকামী মারা যান। আর দুই বছর পরে ২০১৮ সালে মারা যান ২৩০ জন।

বুরহান ওয়ানিকে ভারত সরকার ‘উগ্রপন্থী’ বলে মনে করলেও স্থানীয়দের অনেকেই কাশ্মীরের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি বলে তাকে মনে করেন। তাকে হত্যার পরে যে বিক্ষোভ চলেছিল, সেই সময়েই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি লাগে আদিল আহমেদ দারের পায়ে। তাকে প্রায় ১১ মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল।

তার বাবা গুলাম হাসান দারের কথায়, “ওই সময় হঠাৎই আদিল বদলে গেল। যে শান্ত, লাজুক ছেলে ছিল ও, সেটা যেন একটা আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠল। কিন্তু কোনো দিনই খোলাখুলি আলোচনা করেনি এগুলো নিয়ে।”

কেউ কেউ বলেন, কাশ্মীরের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিল আদিল। আদিলের এক আত্মীয় আলতাফ বলছিলেন, “তার রাগ ছিল একদিকে যখন স্বাধীনতাকামীদের মুরগির মতো মারা হচ্ছে, অন্যদিকে কোনো হতাহত হচ্ছে না কেউ।”

পুলওয়ামারই আরেক বাসিন্দা জিব্রান আহমেদ বলছিলেন, “উগ্রপন্থী তো আমাদের বাড়িতে তৈরি হয় না। থানা বা সেনা ছাউনিতে তৈরি হয়। ২০১৬ সালে পুলিশ যেসব যুবকদের গ্রেপ্তার করেছিল, তাদের বেশির ভাগই এখন উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোতে নাম লিখিয়েছে। হয়তো তাদের মনে হয়েছে যে, প্রতিদিন এভাবে অপমানিত, নির্যাতিত হওয়ার থেকে সেটাই ভালো পথ।”

থিংক ট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষক সুশান্ত সারিন বলছেন, সমস্যাটার অন্যদিকটা হল হিংসাকে মহিমান্বিত করে তোলা হয় অনেক সময়ে। বেশির ভাগ সমাজে হিংসায় অংশ নেওয়া মানুষদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু কাশ্মীরে ব্যাপারটা উল্টো। লোকে যখন পাথর ছুড়ছে, অস্ত্র তুলে নিচ্ছে, তখন কি সরকার চুপচাপ বসে থাকবে?

তবে কাশ্মীরের এক পুলিশ কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, ভারত যে পদ্ধতি নিয়েছে, তা তো সফল হচ্ছে না দেখাই যাচ্ছে। আপনি একজন উগ্রপন্থীকে মারলেন তো আরও দু’জন উগ্রপন্থায় নাম লেখাতে তৈরি হয়ে গেল। রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা না করে উগ্রপন্থীদের মেরে ফেলার ওপরে ইদানীং জোর দেওয়া হচ্ছে বেশি।

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ অজয় সাহানীর মতে, “ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি কাশ্মীর উপত্যকাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। গোটা ভারতের জন্য উপত্যকা যেন একটা শত্রু মনোভাবাপন্ন অঞ্চল। এটা একটা সফল নির্বাচনী রণনীতি হতে পারে, কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে একেবারেই ভুল স্ট্র্যাটেজি।”