কোরআনের কিছু কথা- ৭

কোরআন শুধুমাত্র ভয় দেখায় না, আশার আলোও জ্বালায় [দ্বিতীয় পর্ব]

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ১২ মে ২০১৯ ০৫:১৩ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৭৬৫ বার।

হযরত আহনাফ এবার ভিন্ন পথ ধরে কোরআনে নিজের ছবি খুঁজতে শুরু করলেন। এ পথেও তাঁর সাথে আরো বিভিন্ন দল উপদলের সাক্ষাত হলো। প্রথমত, তিনি পেলেন এমন একটি দল, যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই, তখন তারা গর্ব ও অহংকার করে এবং বলে, আমরা কি একটি পাগল ও কবিয়ালের জন্যে আমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করবো?” -সূরা আছ ছাফফাত : ৩৫-৩৬
তিনি আরো সামনে এগুলেন, দেখলেন আরেক দল লোক সম্পর্কে বলা হয়েছে -
“যখন এদের সামনে আল্লাহ নাম উচ্চারণ করা হয় তখন এদের অন্তর অত্যন্ত নাখোশ হয়ে পড়ে, অথচ যখন এদের সামনে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যদের কথা বলা হয় তখন এদের মন আনন্দে নেচে ওঠে।”-সূরা আঝ ঝুমার : ৪৫
তিনি আরো দেখলেন, কতিপয় হতভাগ্য লোককে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে - 
“তোমাদের কিসে জাহান্নামের এই আগুনে নিক্ষেপ করলো? তারা বলবে, আমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করতাম না, আমরা গরীব মিসকিনদের খাবার দিতাম না, কথা বানানো যাদের কাজ -আমরা তাদের সাথে মিশে সে কাজে লেগে যেতাম। আমরা শেষ বিচারের দিনটিকে অস্বীকার করতাম। এভাবেই একদিন মৃত্যু আমাদের সামনে এসে হাযির হয়ে গেলো।” -সূরা আল মোদ্দাস্সের : ৪২-৪৭
এবার হযরত আহনাফ এ ধরনের লোকদের কথা ভাবলেন। এ ধরনের গুনাহগার লোকদের অবস্থা দেখে মনে মনে বললেন, হে আল্লাহ্, এ ধরনের লোকদের ওপর আমি তো ভয়ানক অসন্তুষ্ট। আমি এদের ব্যাপারে তোমার আশ্রয় চাই। এ ধরনের লোকদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। হযরত আহনাফ কোনো অবস্থায়ই নিজেকে এই লোকদের দলে শামিল বলে ধরে নিতে পারলেন না। এখানে তো সব আল্লাহর গুনাহগার লোকদের কথা বলা হয়েছে। কিন্ত আমার কথা কই? আমার ছবি তো এর কোথাও আমি দেখলাম না, অথচ এ কেতাবে নাকি তুমি সবার কথাই বলেছো?
হযরত আহনাফ এতক্ষণ কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ধরনের মানুষের বিভিন্ন চেহারা ছবি ও তাদের কথা দেখলেন। তিনি কোরআনে দুই শ্রেণির লোকদের সন্ধান পেলেন। প্রথমে দেখলেন আল্লাহর নেককার বান্দাদের কথা, শেষে দেখলেন আল্লাহর গুনাহগার লোকদের কথা বলা হয়েছে। তিনি নিজেকে প্রথম শ্রেণির লোকদের কাতারে শামিল করতে পারছেন না। আবার নিজেকে শেষোক্ত শ্রেণির লোকদের কাতারেও শামিল করতে পারছেন না। তিনি জানতেন, তাঁর স্থান যদিও প্রথম শ্রেণির সম্মানিত নেককার লোকদের কাতারের মধ্যে নয় কিন্তু তাই বলে তাঁর স্থান শেষোক্ত শ্রেণির গুনাহগার লোকদের কাতারের মধ্যেও তো নয়। 
হযরত আহনাফের মনে নিজের ঈমানের যেমন দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, তেমনি নিজের গুনাহ খাতার স্বীকৃতিও সেখানে সমানভাবে মজুদ ছিলো। কোরআনের পাতায় তাই এমন একটি ছবির সন্ধান তিনি করেছিলেন, যাকে তিনি একান্ত নিজের  বলতে পারেন। সেটার সাথে আল্লাহ্তায়ালার ক্ষমা ও দয়ার প্রতিও তিনি ছিলেন গভীর আস্থাশীল । তিনি নিজের নেক কাজগুলোর ব্যাপারে যেমন খুব বেশি অহংকারী ও আশাবাদী ছিলেন না, তেমনিভাবে আল্লাহ্তায়ালার রহমত থেকেও তিনি নিরাশ ছিলেন না। কোরআনের পাতায় তিনি এমনি একটি ভালো-মন্দ মেশানো মানুষের ছবি খুঁজছিলেন এবং তাঁর একান্ত বিশ্বাস ছিলো এমনি একটি মানুষের ছবি অবশ্যই তিনি এই জীবন্ত পুস্তকের কোথাও না কোথাও পেয়ে যাবেন। 
হযরত আহনাফ ভাবছেন, তারা কি আল্লাহন বান্দা নয় যারা ঈমানের দৌলত পাওয়া সত্ত্বেও নিজেদের গুনাহর ব্যাপারে একান্ত অনুতপ্ত থাকে। আল্লাহতায়ালা কি এদের সত্যিই নিজের অপরিসীম রহমত থেকে মাহরূম রাখবেন? এই কেতাবে যদি সবার কথা থাকতে পারে তাহলে এ ধরনের লোকের কথা থাকবে না কেন? এই কেতাব যেহেতু সবার, তাই এখানে তাঁর ছবি কোথাও থাকবে না -এমন তো হতেই পারে না। তিনি হাল ছাড়লেন না। এ কোরআনে নিজের ছবি খুঁজতে লাগলেন। আবার তিনি কেতাব খুললেন। কোরআনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক জায়গায় সত্যিই হযরত আহনাফ নিজেকে উদ্ধার করলেন। খুশিতে তাঁর মন ভরে উঠলো। আজ তিনি কোরআনে নিজের ছবি খুঁজে পেয়েছেন, সাথে সাথেই বলে উঠলেন, হ্যাঁ, এই তো আমি!
“হ্যাঁ, এমন ধরনের কিছু লোকও আছে যারা নিজেদের গুনাহ স্বীকার করে। এরা ভালো-মন্দ মিশিয়ে কাজ করে -কিছু ভালো কিছু মন্দ। আশা করা যায় আল্লাহ্তায়ালা এদের ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ তায়ালা বড় দয়ালু বড় ক্ষমাশীল।”-সূরা আত তাওবা : ১০২
হযরত আহনাফ আল্লাহর কেতাবে নিজের ছবি খুঁজে পেয়ে গেলেন, তিনি  বললেন, হ্যাঁ, এতক্ষণ পর আমি আমাকে উদ্ধার করেছি। আমি আমার গুনাহর কথা অকপটে স্বীকার করি, আমি যা কিছু ভালো কাজ করি তাও আমি অস্বীকার করি না। এটা যে আল্লাহর একান্ত দয়া তাও আমি জানি। আমি আল্লাহ্র দয়া ও তাঁর রহমত থেকে নিরাশ নই। কেননা এই কেতাবেই অন্যত্র বলছে- 
“আল্লাহর দয়া থেকে তারাই নিরাশ হয় যারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট।” -সূরা আল হেজর:৫৬
হযরত আহনাফ দেখলেন, এসব কিছুকে একত্রে রাখলে যা দাঁড়ায় তাই হচ্ছে তাঁর ছবি। কোরআনের মালিক আল্লাহ তায়ালা  নিজের এ গুনাহগার বান্দার কথা তাঁর কেতাবে বর্ণনা করতে সত্যিই ভুলেন নি! হযরত আহনাফ সেই কোরআন পাঠকের কথার সত্যতা অনুধাবন করে নীরবে বলে উঠলেন, হে মালিক, তুমি মহান, তোমার কেতাব মহান, সত্যিই তোমার এ কেতাবে দুনিয়ার গুণী-জ্ঞাণী, পাপী-তাপী, ছোট-বড়, ধনী-র্নিধন, সবার কথাই আছে। তোমার কেতাব সত্যিই অনুপম।

চলবে...