কোরআনের কিছু কথা-১০

মদ খাওয়া যেভাবে হারাম হলো 

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ১৮ মে ২০১৯ ০৫:৫১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৫৯৪ বার।

ইসলামের প্রথম যুগে জাহেলিয়াত আমলের সাধারণ রীতিনীতির মত মদ্যপানও স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো। অত:পর রাসূল করীম (সা:) যখন হিজরত করে মদীনায় আমগন করেন, তখনও মদীনাবাসীদের মধ্যে মদ্যপান ও জুয়ার প্রথা প্রচলিত ছিলো। সাধারণ মানুষ এ দুটি বস্তুর শুধু বাহ্যিক উপকারিতার প্রতি লক্ষ করেই এতে মত্ত ছিলো। কিন্তু এগুলোর অন্তর্নিহিত অকল্যাণ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিলো না। তবে আল্লাহ্র নিয়ম হচ্ছে এই যে, প্রতিটি জাতি ও প্রতিটি অঞ্চলে কিছু বুদ্ধিমান ব্যক্তিও থাকেন, যারা বিবেক বুদ্ধিকে অভ্যাসের ঊর্ধ্বে স্থান দেন। যদি কোনো অভ্যাস বুদ্ধির বা যুক্তির পরিপন্থি হয়, তবে সে অভ্যাসের ধারে কাছেও তাঁরা যায় না। এ ব্যাপারে নবী করীম (সা:)-এর স্থান ছিলো সবচেয়ে ঊর্ধ্বে। কেননা যেসব বস্তু কোনো কালে হারাম হবে, এমন সব বস্তু হতেও তাঁর অন্তরে পূর্ব থেকেই একটা সহজাত ঘৃণা ছিলো। সাহাবিগণের মধ্যেও এমন কিছু সংখ্যক লোক ছিলেন, যাঁরা হালাল থাকাকালেও মদ্যপান তো দূরের কথা, স্পর্শও করেননি। 
মদীনায় পৌঁছার পর কতিপয় সাহাবিও এসব বিষয়ের অকল্যাণগুলো অনুভব করলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ফারুকে আযম হযরত ওমর রা:, হযরত মা’আয ইবনে জাবাল রা: এবং কিছু সংখ্যক আনসার সাহাবি রা: রাসূলে করীম (সা:)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেন: মদ ও জুয়া মানুষের বুদ্ধি বিবেচনাকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে ফেলে এবং ধন-সম্পদও ধ্বংস করে দেয়; এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি? এ প্রশ্নের উত্তরেই সূরা আল বাকারা-এর ২১৯ নং আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহ ঘোষণা করছেন
“লোকেরা জিজ্ঞেস করছে: মদ ও জুয়া সম্পর্কে কি নির্দেশ? বলে দাও: এ দুটি জিনিসেই বড় পাপ রয়েছে, যদিও এতে লোকদের জন্য কিছুটা উপকারিতাও আছে; কিন্তু উভয় কাজের পাপ উপকারিতা থেকে অনেক বেশি, ........................................ । -সূরা আল বাকারা: ২১৯।”    
এটাই হচ্ছে মদ্যপান সংক্রান্ত প্রথম আয়াত, যা মুসলমানদের মদ হতে দূরে রাখার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, মদ ও জুয়াতে যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে কিছু উপকারিতা পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু এই দুটির মাধ্যমেই অনেক বড় বড় পাপের পথ উন্মুক্ত হয়, যা এর উপকারিতার তুলনায় অনেক বড় ও ক্ষতিকর। পাপ অর্থে এখানে সেসব বিষয়ও বোঝানো হয়েছে, যা পাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন মদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দোষ হচ্ছে এই যে, এতে মানুষের সবচাইতে বড় গুণ, বুদ্ধি বিবেচনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর বুদ্ধি এমন একটা গুণ, যা মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। পক্ষান্তরে যখন তা থাকে না, তখন প্রতিটি মন্দ কাজের পথই সুগম হয়ে যায়। [কোনো কোনো তাফসীরকারক বাহ্যিক দৃষ্টিতে মদের কিছু উপকারিতা বলতে ব্যবসায়িক উপকারিতা বোঝানো হয়েছে বলে মনে করেছেন।]
এ আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় মদকে হারাম করা হয়নি; কিন্তু এর অনিষ্ট ও অকল্যাণের দিকগুলোকে তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, মদ্যপানের দরুণ মানুষ অনেক মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। বলতে গেলে আয়াতটিতে মদ্যপান ত্যাগ করার জন্য এক প্রকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সূতরাং এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর কোনো কোনো সাহাবি এ পরামর্শ গ্রহণ করে তৎক্ষণাৎ মদ পান ত্যাগ করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেছেন, এ আয়াতে মদকে হারাম করা হয়নি, বরং এটা ধর্মের পক্ষে ক্ষতিকর কাজে ধাবিত করে বলে একে পাপের কারণ বলে স্থির করা হয়েছে। যাতে ফেতনায় পড়তে না হয়, সে জন্য পূর্ব থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।  
মদের ব্যাপারে পরবর্তী আয়াতটি নাযিল হওয়ার ঘটনাটি এইরূপ: একদিন হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা:) সাহাবিগণের মধ্য হতে তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে আহারের পর প্রথা অনুযায়ী মদ্যপানের ব্যবস্থা করলেন এবং সবাই মদ্যপান করলেন। এমতাবস্থায় মাগরিবের নামাজের সময় হলে সবাই নামাজে দাঁড়ালেন এবং একজনকে ইমামতি করতে আগে বাড়িয়ে দিলেন। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি সূরা আল-কাফিরূন ভুল পড়তে লাগলেন, তখনই মদ্যপান হতে বিরত রাখার জন্যে দ্বিতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো। এরশাদ হলো:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নেশায় মাতাল অবস্থায় থাকো, তখন নামাজের কাছেও যেও না। নামাজ তখন আদায় করবে, যখন তোমরা কি বলছো, তা সঠিকরূপে জানতে পারবে, ..................................................।-সূরা আন-নিসা-৪৩।”
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা নামাজের কাছেও যেও না। এতে নামাজের সময় মদ্যপানকে হারাম করা হয়েছে। তবে অন্যান্য সময় তা পান করার অনুমতি তখনও পর্যন্ত বহাল। পরবর্তীতে বহু সংখ্যক সাহাবি এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরই মদ্যপান সম্পূর্ণ বর্জন করেছিলেন। ভেবেছিলেন যে বস্তু মানুষকে নামাজ থেকে বিরত রাখে, তাতে কোনো কল্যাণই থাকতে পারে না। যখন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজ পড়তে নিষেধ করা হয়েছে, তখন এ বস্তুর কাছে যাওয়া উচিত নয়, যা মানুষকে নামাজ থেকে বঞ্চিত করে।     
মদের ব্যাপারে চূড়ান্ত নির্দেশ:
মদ্যপান সম্পর্কে যেহেতু নামাজের সময় ব্যতীত অন্যান্য সময়ের জন্য পরিষ্কারভাবে নিষেধ করা হয়নি, সেহেতু কেউ কেউ নামাজের সময় ব্যতীত অন্যান্য সময়ে মদ্যপান করতে থাকেন। ইতিমধ্যে আরো একটি ঘটনা সংঘটিত হয়ে যায়। হযরত আতবান ইবনে মালেক (রা:) কয়েকজন সাহাবিকে নিমন্ত্রণ করেন, যাঁদের মধ্যে হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা:)ও উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া দাওয়ার পর মদপান করার প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে গেল। আরবদের প্রথা অনুযায়ী নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কবিতা প্রতিযোগিতা এবং নিজের বংশ ও পূর্ব-পুরুষদের অহংকারমূলক বর্ণনা আরম্ভ হয়। হযরত সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা:) একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন, যাতে আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের প্রশংসা কীর্তন করা হয়। ফলে একজন আনসার যুবক রাগান্বিত হয়ে উটের গণ্ডদেশের একটি হাড় সা’দ এর মাথায় ছুঁড়ে মারেন। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হোন। পরে সা’দ (রা:) রাসূল (সা:)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে উক্ত আনসার যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তখন হুজুর (সা:) দোয়া করলেন: “হে আল্লাহ্! শরাব সম্পর্কে আমাদেরকে একটি পরিষ্কার বর্ণনা ও বিধান দান করো।” তখনই সূরা মায়েদা-এর ৯০ নং আয়াত নাযিল হয়। এর মাধ্যমে মদকে সম্পূর্ণ হারাম করা হয়েছে। আল্লাহ ঘোষণা করেন
“হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো (তোমরা জেনে রেখো), মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়কারী শর হচ্ছে ঘৃণিত শয়তানের কাজ, অতএব তোমরা তা (সম্পূর্ণরূপে) বর্জন করো, আশা করা যায় তোমরা মুক্তি পেয়ে যাবে। -সূরা মায়েদা: ৯০।”
এরপর মদের অপকারিতা সম্পর্কে আল্লাহ ঘোষণা করছেন
“শয়তান মদ ও জুয়ার মধ্যে (ফেলে) তোমাদের মাঝে শত্র“তা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিতে চায় এবং এভাবেই সে তোমাদের আল্লাহ তায়ালার স্মরণ ও নামাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, (এরপরও) কি তোমরা (এ কাজ থেকে) ফিরে আসবে না?-সূরা মায়েদা: ৯১। ”
এভাবেই মদ পান মুসলিমদের জন্য সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে গেলো।

(পরবর্তী অংশ আগামীকাল)