মদপানের অপরাধে যে শাস্তি দেয়া হতো

কোরআনের কিছু কথা [শেষ]

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ২১ মে ২০১৯ ০৭:৫৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৪১ বার।

[গতকালের পর থেকে পড়তে হবে] 
মদ পান করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোনো অবস্থাতেই এটা খাওয়ার অনুমতি নেই। অনেকে মদ হারাম হওয়ার সর্বশেষ নির্দেশ সূরা মায়েদার ৯০ নং আয়াত না জেনে শুধুমাত্র সূরা বাকারার ২১৯ নং আয়াত ও সূরা আন নিসার ৪৩ নং আয়াত থেকে বোঝার চেষ্টা করেছে যে, মদপান করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়। তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এই ভুল ধারণা ভেংগে দিতে মদ হারাম হওয়ার আয়াতগুলো পুনরায় তুলে ধরা যাক। আল্লাহ ঘোষণা করছেন-
“(লোকেরা) জিজ্ঞেস করছে, মদ ও জুয়া সম্পর্কে কি নির্দেশ? বলে দাও এ দুটি জিনিসেই বড় পাপ রয়েছে, যদিও এতে লোকদের জন্যে কিছুটা উপকারিতাও আছে, কিন্তু উভয় কাজের পাপ উপকারিতা থেকে অনেক বেশি, ---------।-সূরা বাকারা: ২১৯।”
মদ ও জুয়া সম্পর্কে অবতীর্ণ এটিই সর্বপ্রথম আয়াত। এ আয়াতে মদ ও জুয়ার দোষ প্রকাশ করা এবং তা পছন্দনীয় নয় এ ভাবটাই ব্যক্ত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, পরবর্তীতে তাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বা হারাম ঘোষণা করে যে নির্দেশ আসবে তা হৃদয়ঙ্গম বা কবুল করা জন্য জনমনে যেন পূর্ব থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকে। 
এরপর আল্লাহ ঘোষণা করছেন-
ওহে ঈমানদাররা (যারা বিশ্বাসের অধিকারী!) তোমরা যখন নেশায় মাতাল অবস্থায় থাকো, তখন নামাজের কাছেও যেও না, নামাজ তখন আদায় করবে যখন তোমরা কি বলছো, তা সঠিকভাবে জানতে পারবে, ---------------।-সূরা আন নিসা: ৪৩। ”
মদ পান সম্পর্কে এটা দ্বিতীয় নির্দেশ। প্রথম নির্দেশ সূরা আল বাকারার ২১৯নং আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। তাতে শুধু এটুকু ধারণা দিয়েই ক্ষান্ত করা হয়েছিলো যে, মদ অত্যন্ত খারাপ জিনিস; আল্লাহ তায়ালা তা আদৌ পছন্দ করেন না। এর ফলেই মুসলমানদের বেশ কিছু লোক মদ্যপান পরিত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তারপরেও বহু লোক মদ্যপানে আগের মতোই লিপ্ত ছিলো। এমনকি অনেক সময় একেবারে মাতাল অবস্থায় নামাজ আদায় করতে জামা’আতে দাঁড়িয়ে যেতে লাগলো। এর ফলে নামাজের মধ্যে যা পড়ার নয় তাই পড়তে লাগলো। ৪র্থ হিজরির প্রথম ভাগেই এ দ্বিতীয় নির্দেশ নাযিল হয় এবং মাতাল অবস্থায় নামাজ আদায় করতে নিষেধ করা হয়। এর দরুন লোকেরা মদ্যপানের নির্দিষ্ট সময় পরিবর্তন করে ফেললো এবং নেশা অবস্থায় নামাজ আদায় করতে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন সময়ে মদ্যপান বন্ধ করলো। অর্থাৎ নামাজের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই মদ্যপান সেরে ফেলতো অথবা নামাজের ওয়াক্ত অতিক্রান্ত হওয়ার পর মদ্যপান শুরু করতো। এর কিছুদিন পরই মদ্যপান নিষিদ্ধ করার বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা অবতীর্ণ হয়, যা সূরা মায়েদার ৯০নং আয়াতে উল্লি¬খিত হয়েছে। 
আল্লাহ ঘোষণা করছেন-
“হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো (তোমরা জেনে রেখো), মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়কারী শর হচ্ছে ঘৃণিত শয়তানের কাজ, অতএব তোমরা তা (সম্পূর্ণরূপে) বর্জন করো, আশা করা যায় তোমরা মুক্তি পেয়ে যাবে। -সূরা মায়েদা: ৯০। ”
এ আয়াতে চারটি জিনিসকে চূড়ান্তভাবে হারাম করে দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে (১) শরাব বা মদ, (২) জুয়া, (৩) যেসব জায়গায় আল্লাহ ছাড়া অপর কোনো শক্তির ইবাদত করা হয় এবং যেসব জায়গা আল্লাহ ছাড়া অপর কারো নামে বলিদান বা উৎসর্গ করার জন্যে নির্দিষ্ট করা হয়েছে , (৪) চতুর্থ হলো ভাগ্য নির্নায়ক শর বা তীর (অন্য অর্থে পাশা)। 
এই আয়াতটির আগে মদ্যপান হারাম হওয়া সম্পর্কে দুটি হুকুম এসেছে। হুকুম দুটি যথাক্রমে সূরা বাকারার ২১৯ আয়াত এবং সূরা আন নিসার ৪৩নং আয়াতে উল্লি¬খিত রয়েছে। তবে সূরা মায়েদার ৯০ নং এই আয়াতটিই হচ্ছে মদ হারাম করা সম্পর্কে সর্বশেষ আয়াত।
এরপর মদের অপকারিতা সম্পর্কে আল্লাহ ঘোষণা করছেন-
“শয়তান মদ ও জুয়ার মধ্যে (ফেলে) তোমাদের মাঝে শত্র“তা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিতে চায় এবং এভাবেই সে তোমাদের আল্লাহ তায়ালার স্মরণ ও নামাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, (এরপরও) কি তোমরা (এ কাজ থেকে) ফিরে আসবে না?-সূরা মায়েদা: ৯১। ”
এভাবেই মদ্যপান মুসলিমদের জন্য সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে গেলো। যাহোক, মদ পানের অপরাধে যেসব শাস্তি দেয়া হতো এখন সবশেষে তা একটু বলা দরকার।
হযরত নবী করীম (সা:) এর সময়ে মদপায়ীদের জন্য বিশেষ কোনো দণ্ড নির্দিষ্ট ছিলো না। মদপানের অপরাধে কেউ গ্রেফতার হয়ে এলে তাকে পাকানো কাপড় অথবা খেজুরের ছড়া দ্বারা প্রহারমূলক শাস্তি দেওয়া হতো। খুব বেশির পক্ষে ৪০ বার আঘাত দেওয়ার নিয়ম ছিলো রাসূলের সময়ে। হযরত আবু বকর (রা:)-এর সময়েও ৪০টি চাবুক মারা হতো। হযরত উমর (রা:) এর খিলাফাত কালেও শুরুতে ৪০টি চাবুকই মারা হতো। কিন্তু পরে যখন তিনি দেখলেন যে, লোকেরা এ অপরাধ পরিত্যাগ করছে না, তখন তিনি সাহাবায়ে কেরামের সংগে পরামর্শ করে ৮০টি চাবুকের প্রহার দণ্ড হিসাবে নির্দিষ্ট করেন। ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফা এবং এক বর্ণনা মোতাবেক ইমাম শাফেয়ীও মদ পানের এ দণ্ডকেই চালু করেছেন। কিন্তু ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং অপর এক বর্ণনা অনুসারে ইমাম শাফেয়ী ৪০টি চাবুক মারার কথা বলেছেন। হযরত আলী (রা:) একে সমর্থন করেছেন। হযরত উমর (রা)-এর খিলাফাতকালে বনী সকীফের রুয়াইশিদ নামক এক ব্যক্তির দোকান জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয়েছিলো। অপর এক সময় গোটা গ্রাম হযরত উমর (রা:)-এর আদেশে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কেননা সেখানে গোপনে মদ উৎপাদন ও বিক্রয়ের ব্যবসা খুব ব্যাপকভাবে চলছিলো। 
[‘কোরআনের কিছু কথা’ বিষয়ক আলোচনা ১৩ পর্বে আপাতত সমাপ্ত হলো, পরবর্তীতে এই একই বিষয়ে আরো লেখা থাকবে, ইনশাল্লাহ্। তবে আগামীকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘আমাদের মা জননী’ বিষয়ক আলোচনা, চোখ রাখুন।]