আমাদের মা জননী-৩

আয়েশা রা: অঝোর ধারায় কাঁদলেন 

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ২৪ মে ২০১৯ ১৬:৩৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ২৯১ বার।

[গতকালের পর থেকে পড়তে হবে]
সাধারণ স্বাভাবিক একটা ঘটনাকে মদিনায় মোনাফেকরা রঙ লাগিয়ে অপবাদ দিয়ে অপপ্রচার করে বেড়াবে, সেই ধারনা আয়েশা রা: কখনই করেননি। শুধু তিনি কেন ? কোনো মোমেন মুসলমানই তা করতে পারে না। আয়েশা রা: এর নামে কী কী বদনাম ছড়ানো হচ্ছে, সেটার কিছুই তিনি তখন পর্যন্ত জানতে পারেননি। জানলেন কিছুটা পরে। রটনার ঘটনা জানার পর, তিনি মূষঢ়ে পড়লেন, বেদনাহত হয়ে দু’নয়নে অঝোর ধারায় শুধু কাঁদতে থাকলেন। অপবাদের দংশনে সৃষ্ট ফেনিল বিষের যন্ত্রণায় তীব্রভাবে ব্যথিত হলেন। তাঁর সেই মনভাংগা হৃদয়ের বেদনা বিধুর কাহিনীর বর্ণনা তিনি নিজেই দিয়েছেন। আর সেই কাহিনীটি যেন এক বিমূর্ত রাত্রিতে মৌনতায় বলা কথা।
হযরত আয়েশা রা: বলেন, “মদিনার উপস্থিত হওয়ার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রায় একমাস কাল আমি শয্যাশায়ী হয়ে থাকি। শহরের সর্বত্র এ মিথ্যা অপবাদের খবর উড়ে বেড়াচ্ছিল। নবী করিম সা: এর কান পর্যন্ত খবর আসতে দেরি হয়নি। কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না। তবে আমার অসুস্থকালীন অবস্থায় একটি জিনিস আমার মনে খটকা জাগাতো। তা হচ্ছে এই যে, অন্য সময় অসুস্থ হলে রাসূল সা: যে হৃদয়াবেগ নিয়ে আমার কাছে আসতেন, বসতেন এবং দরদের সাথে আমার খোঁজ খবর নিতেন, এ সময়ে কিন্তু আমি সেই মমতাপূর্ণ ব্যবহারটি দেখছিলাম না। তিনি অবশ্য আসতেন, সালাম করতেন এবং শুধু জিজ্ঞাসা করতেন, কেমন আছ? ব্যস, এরপর চলে যেতেন। এই আচরণটাই তাঁর সম্পর্কে আমার মনে কিছু সংশয় সৃষ্টি করেছিলো, কোনো কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমি আমার মায়ের কাছে চলে গেলাম, যেন মা আমার সেবা শুশ্র“ষা ভালোভাবে করতে পারেন।
তারপর (থেকে) আমি আমার আম্মার নিকট স্থানান্তির হলাম। আর তখনো আমাকে নিয়ে যা বলা হচ্ছিলো, সে ব্যাপারে কিছুই আমার জানা ছিলো না। এভাবে কুড়ি দিনের কিছু অধিকাল অতিবাহিত হতে না হতেই আমি দুশ্চিন্তায় অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়লাম। এরপর এক রাত্রিতে আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার জন্যে জংগলের দিকে যাচ্ছিলাম। সেখানেই আমরা (মহিলারা) রাত্রিতে গিয়ে প্রয়োজন সারতাম। এ ঘটনা হচ্ছে সে সময়ের কথা যখন আমাদের সব ঘরে শৌচাগার তৈরি হয়ে পারেনি। আর এজন্যে আমরা রাত ছাড়া বেরুতাম না। একরাত থেকে আরেক রাত পর্যন্ত আমাদের ধৈর্য ধরে থাকতে হতো। 

আমার সাথে মিস্তাহ ইবনে উসাসার আম্মাও ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার আম্মার খালাতো বোন। এ মহিলাটি তাঁর বাবা-মা উভয়ের দিক দিয়ে মোত্তালেব বংশীয়। (যাহোক, আমরা প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ করার নিমিত্তে এগিয়ে যাওয়ার সময়) পথিমধ্যে মিস্তাহর আম্মা তাঁর চাদরের আঁচলে বেঁধে পড়ে গেলেন, আর অমনি বিরক্ত হয়ে (নিজ পুত্রের প্রতি অভিশাপ দিয়ে) বলে উঠলেন, “ধ্বংস হোক মিস্তাহ!” আমি বললাম, “আপনি কী রকম মা? নিজ পুত্রের ধ্বংস কামনা করেন। আর আপনার পুত্রও এমন যিনি বদর যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন।” তিনি (  মিস্তাহর আম্মা) বললেন, “রাখো তার কথা হায়! তুমি শোনোনি যে সে কী কথা বলেছে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী বলেছে সে? অতঃপর তিনি সমস্ত কাহিনী আমাকে খুলে বললেন। রটনাকারী মিথ্যাবাদীরা আমার সম্পর্কে কী কী বলে বেড়াচ্ছিলো, তা সবই আমাকে তিনি শোনালেন। [মোনাফেকদের দ্বারা রটানো ও অপবাদের মিথ্যা প্রচারণায় যে তিনজন সরলমনা মুসলমান বিভ্রান্ত হয়ে সে মিথ্যা অভিযানে শরীক হয়ে পড়েছিলেন, তাদের মধ্যে মিস্তাহ ইবনে উসাসা একজন।]
এ কাহিনী শুনে আমার রক্ত যেন পানি হয়ে গেলো। যে জন্যে এসেছিলাম সে প্রয়োজনের কথাও ভুলে গেলাম। সোজা ঘরে চলে গেলাম। তারপর থেকে সেই যে কাঁদতে শুরু করলাম, তা আর থামে না। এমনকি একপর্যায়ে আমার মনে হলো যে, আমার কলিজা ফেটে যাবে। আমার আম্মাকে আমি বললাম, “লোকে এত কথা বলাবলি করলো, অথচ আপনি আমার কাছে সেটার বিন্দু বিসর্গও প্রকাশ করলেন না!” উত্তরে তিনি বললেন, “তুমি শান্ত হও। এটাতো খুবই সাধারণ ব্যাপার, এতে তোমার মন খারাপ করার কিছুই নেই। যে স্বামীর কাছে তার কয়েকজন স্ত্রীর মধ্যে কোনো একজন স্ত্রী খুবই প্রিয় হয়, সেখানে এরূপ ঘটনা ঘটে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।” এসব শুনে আমি বললাম, “সোবহানাল্লাহ! আর এই নিয়ে লোকেরাও বলাবলি করতে পারছে? অত:পর সারারাত ধরে আমি কাঁদলাম। সকাল হয়ে গেলো, এক মূহুর্তের জন্যেও আমার চোখের পানি থামেনি এবং সারারাতের মধ্যে একটি বারের জন্যেও আমার চোখের পাতা বন্ধ হয়নি। তারপর ক্রন্দনরত অবস্থাতেই সকাল করেছি।”  

[পরবর্তী অংশ আগামীকাল]