ছোটগল্পঃ নাম তার মানুষ

অসীম কুমার কৌশিক
প্রকাশ: ২৫ মে ২০১৯ ০৭:১৩ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩৮৩ বার।

মা আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাবা কোথায়? এইতো মা আর একটু আমারও হয়ে গেছে। তোর বাবা বাথরুমে গেছে। ওইতো বাবা এসেছে।
আমি অন্তরা। দশম শ্রেণীতে পড়ি। আমার সাথেই স্কুলে যাবার জন্য যিনি রেডি হচ্ছেন তিনি আমার মা। আমাদের স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা। আর বাথরুম থেকে এইমাত্র যে মানুষটি বের হলেন তিনি আমার বাবা। আমি প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় বাবা-মাকে একসাথে প্রণাম করে বাড়ি থেকে বের হই। 
মা তুমি বাবার পাশে দাড়াও। পাগলি মেয়ে একটা বলে মুচকি হেসে মা গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ালো। আমি প্রতিদিনের মতোই দুজনকে প্রণাম করলাম। অমনি প্রথমে বাবা তারপর মা আমার কপালে চুমু এঁকে দিলো। 
অনেক হয়েছে এবার চল তাড়াতাড়ি নইলে আর সময় মতো স্কুলে পৌঁছতে পারবো না। আমরা দুজন বেরিয়ে গেলে বাবা দরজায় দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি বার বার পেছনে তাকিয়ে সে দৃশ্য দেখতে থাকি যতক্ষণ না চোখের সীমার বাইরে চলে যাই। 
বাড়ি থেকে আমাদের স্কুল দশ মিনিটের পথ। কাল থেকে আমাদের স্কুলের গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হবে। ছুটিতে কে কোথায় বেড়াতে যাবে তাই নিয়ে একরকম হৈ-চৈ পরে গেলো ক্লাস্রুমে। অবেশেষে স্যার এসে একটা ছোট করে ধমক দিয়ে গেলেন। যেহেতু কাল থেকে স্কুল একাটনা ছুটি হয়ে যাচ্ছে তাই স্যার ধমকটা একটু ছোট করে দিলেন। যাই হোক সবার মতো ছুটি নিয়ে আমিও পরিকল্পনা করলাম। সেটা শুধু স্কুল থেকে ফেরার পথে মাকে বলেছি আর কাউকে বলিনি। মা তো শুনে অবাক হয়ে গেলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো সবাই ছুটিতে বেড়াতে চায়।আর তুই তোর মা- বাবাকে নিয়ে লিখতে চাস! 
স্কুল ছুটির দু’দিন হলো। রাতের খাবার খেয়েই টেবিলে খাতা আর কলম নিয়ে লিখতে বসলাম তাঁদের নিয়ে। যাদের জন্য আমার প্রকৃতির এই অপরুপ সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। 
আমার বাবার নাম মানুষ। কিন্তু এটা আবার কেমন নাম। সবাই হয়তো একটু অবাক হচ্ছেন। হ্যাঁ ইনিই আমার বাবা, নাম তাঁর মানুষ। মানুষ নামের পেছনে একটা ইতিহাসও রয়েছে। সেটা অন্য একসময় বলবো। যাই হোক জন্মের পর প্রত্যেক শিশুরই ঘটা করে একটি সুন্দর নাম রাখা হয়। বাবার বেলায় এর ব্যতিক্রম হয় নি। দাদু-দিদা শখ করে চন্দন নাম রেখেছিলো তাঁদের ছেলের। কিন্তু সে নাম আর সবাই জানলেও বাবার জানা হয় নি কখনো। তাঁর জন্মটা স্বাভাবিক ছিলো কিন্তু বেড়ে উঠা নয়। কেননা জন্ম থেকেই বাবা বধীর ছিলেন। কিছু শুনতেও পারেন না, কিছু বলতেও পারেন না।   

আমার মায়ের নাম নবমিতা। এক বিকেলে আশ্চর্যজনক ভাবে বাবাকে আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। তখন মা সবে মাত্র স্কুলে জয়েন করেছে। সেদিন বিকেলে মা স্কুল থেকে ফিরছিলো। হঠাত একটু সামনে চোখ যেতেই মা দেখতে পায় একটা লোক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।  এমন সময় খুব দ্রুত গতিতে একটা বাস আসে। কিন্তু লোকটি তবুও ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। দৌড়ে গিয়ে মা লোকটিকে ধাক্কা দেয়।  দুজনেই রাস্তার পাশে পড়ে যায়। বাসটি চলে যায় আপন গতিতে। নিয়তি হয়তো নতুন গল্প তৈরি করতে যাচ্ছে তাই এই ছল। মা উঠে রাস্তার পাশেই বসে । লোকটি তখনো উপর হয়ে পড়ে ছিলো। মা কাছে গিয়ে তাকে টেনে তোলে।  লোকটার কপাল থেকে রক্ত ঝরছিলো। বোধহয় কেটে গেছে। ততক্ষণে চারপাশে অনেক লোক জড় হয়েছিলো। তাদের সহায়তায় লোকটাকে নিয়ে মা কাছেই একটা হাসপাতালে যায়। অনেক কষ্টে লোকটির বাড়ীর ঠিকানা জোগাড় করে খবর দেয় মা। ছুটে আসে সবাই। এর পরের গল্পটা নিয়তি যেনো নিজে হাতে সাজানো ছিলো। 
লোকটাকে ভালোবেসে বিয়ে করে মা। আগলে রাখার দায়িত্ব নেয়। আর ‘মানুষ’ নামটা মায়েরই দেওয়া। 

অনেক গুলো বছর কেটে গেছে মাঝখানে। হঠাত আজ খুঁজে পেলাম মা-বাবাকে নিয়ে লেখা আমার সেই ডায়রিটা। লেখাগুলো কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। জীবনের মতোই বিবর্ণ সে রঙ। আবারো লিখতে শুরু করলাম। 
গল্পটা এখানেই শেষ নয়। পুরনো ডায়রিটা রয়েছে, পুরনো স্মৃতিময় লেখাগুলিও রয়েছে। নেই শুধু মা। বাবাকে আগলে রাখার দায়িত্ব নিয়েছিলো মা। এতটুকুও অবহেলা করেনি সে দায়িত্ব পালনে। জীবোনের অন্তিম বেলা পর্যন্ত ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে আগলে রেখেছে বাবাকে। 
দিনটি ছিলো শুক্রবার। ছুটির দিন। তাই আমরা তিনজন ঘুরতে যাই বাহিরে। কিন্তু ফিরেছিলা শুধু দু’জন। একটা দুর্ঘটনায় বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে চলে যায় মা আমাদের ছেড়ে। অনেক দূরে , অন্য ভূবনে। আজ লিখতে গিয়ে কেউ যেনো হাতটা টেনে ধরছে। মনের মধ্যে যন্ত্রণার ছাপগুলো আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। 
মা দাদু কোথায়। ছাদে গিয়ে দেখতো। আসছি আমি। এখন মায়ের মতো আমিও সংসার জীবনের দায়িত্ব কাধে নিয়েছি। এখুনি যে এসেছিলো সে আমার একমাত্র মেয়ে মিতা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। মায়ের নামের শেষ অংশটাই ওর নাম হয়ে গেছে। বাবা আমাদের সাথেই থাকে। মায়ের ভালোবাসা আগলে রেখেছি আমি। মিতাকে অনেক ভালোবাসে বাবা। দু’জনে বেশ খেলা করে। মা যে স্কুলের শিক্ষক ছিল সেই স্কুলে এখন আমি শিক্ষকতা করি। আমার স্বামী ব্যবসা করে। মিতাকে নিয়ে যখন আমি স্কুলে যাই  বাবা ছাদ থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। কি যানি হয়তো মায়ের সাথে আমার স্কুলে যাবার দৃশ্য এখনো তাঁর চোখে ভাসে!