ধানের দাম কম: বগুড়ায় নিউ মার্কেটে ঈদের কেনাকাটায় চিরচেনা ভিড় নেই

অরূপ রতন, আকতারুজ্জামান সোহাগ ও মিষ্টি রহমান
প্রকাশ: ২৬ মে ২০১৯ ০৪:৫৮ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪৫৮ বার।

রমজান মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও বগুড়ার মার্কেটগুলোতে ঈদের কেনাকাটা তেমন জমে ওঠেনি। শহরের সবচেয়ে বড় নিউ মার্কেটে তৈরি পোষাক ও জুতা-স্যান্ডেলের দোকানগুলোতে দিনের বেলা ক্রেতার সংখ্যা এতটাই কম যে তাদের হাতেই গোনা যায়। সন্ধ্যার পরেও তেমন ভিড় নেই। টেইলার্সগুলো সাধারণত দশ রমজানের পর থেকে জামা-কাপড়ের অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিলেও ক্রেতার অভাবে এবার তারা ঈদের দু’দিন আগ পর্যন্ত অর্ডার নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। 
দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরের নিউ মার্কেটে যারা ঈদের কেনা-কাটা করতে আসেন তাদের একটি বড় অংশই গ্রামের বাসিন্দা। ফসলের কেনা-বেচার ওপর তাদের কেনা-কাটা নির্ভর করে। কিন্তু এবার রমজানের শুরুতে ধান উঠলেও দাম কম হওয়ায় সাধ্য অনুযায়ী কেনাকাটা করতে পারছেন না। তাদের অনেকে হয়তো শহরের পরিবর্তে উপজেলার মার্কেটগুলোতে যাচ্ছেন। তবে এত কিছুর পরেও দোকানিদের আশা শেষ মুহুর্তে ধানের দাম কিছুটা হলেও বাড়বে এবং কৃষক পরিবার  শহরে মার্কেটমুখী হবে।
বগুড়ায় এবার ১ লাখ ৮৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়। এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ধান কাটা শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলার ৭৫ ভাগেরও বেশি জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। তবে নতুন ধান ঘরে এলেও কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ায় কৃষকের মনে তেমন আনন্দ নেই। মোটা জাতের ধান ৪৮০ থেকে ৫০০ টাকা মণ এবং চিকন ৬২০ থেকে ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, এক বিঘা জমিতে বোরো আবাদে তাদের খরচ হয়েছে গড়ে ১০ হাজার টাকা। আর ধান বিক্রি করে তারা পাচ্ছেন ১১ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা।
নিউ মার্কেটের ‘প্রাইড শাড়ি ঘরের’ ম্যানেজার ফজলুল হক বলেন, এখন পর্যন্ত ক্রেতাদের ভিড় চোখে পড়ছে না। ধানের দাম কম হওয়ায় গ্রামের ক্রেতাদের দেখা মিলছে না। ‘কবির ক্লোথ স্টোরের’ বিপ্লব নামে এক কর্মী ২২ বছর ধরে দোকানে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, এবারের মত এত ধীর গতির বেচা-কেনা আগে কখনো দেখিনি। গ্রামের ক্রেতারা আসছে না বলেই ভিড় নেই। ধানের দাম না বাড়লে হয়তো ভিড়ও বাড়বে না। ‘ওসমানিয়া ক্লোথ স্টোরের’ মালিক আসলাম হোসেন বলেন, এবার ঈদে বেচা-কেনা এতটাই কম যে লাভ তো দূরের কথা লোকসান গুণতে হতে পারে। 
‘ড্রেস হাউসের’ মালিক ফেরদৌস জামান ফিরোজ জানান, গত ঈদ মৌসুমে এই সময়ে তিনি তার দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৭০ হাজার টাকার পোশাক বিক্রি করলেও এবার তা কমে ২০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। জুতার দোকান ‘বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সে’ কর্মরত বিপ্লব হাসান বলেন, গেল ঈদ মৌসুমে আমার দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৫০ জন এলেও এবার তার অর্ধেকেরও দেখা মিলছে না। তবে মামুন নামে অপর এক তৈরি পোষাকের দোকানের মালিক বলেন, সরকারিভাবে ধান কেনা যেহেতু শুরু হয়েছে তাই ধারণা করছি ধানের দাম কয়েকদিনে কিছুটা হলেও বাড়বে। তখন হয়তো গ্রামের লোকজন ঈদের কেনাকাটার জন্য শহরমুখী হবে।
বুধবার বিকেলে কথা হয় বগুড়া ড্রেস কিং টেইলার্সের ম্যানেজার রাসেল মাহমুদ শাকিলের সঙ্গে। তিনি জানান, কাজের ব্যস্ততার কারণে প্রতি বছর দশ রমজানের পর থেকে তাদের অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু এবার মার্কেটে লোকজন আসছেন কম। তাই অর্ডারও নেই। ‘এম হাসান টেইলার্সের’ ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন বলেন, এবার ব্যবসায় বেশ মন্দা। আমরা সবাই ঈদে বেশি অর্ডারের আশা করে থাকি। কিন্তু এবার যা অবস্থা দেখছি, ঈদের দুই দিন আগ পর্যন্ত অর্ডার না নিয়ে উপায় থাকবে না।
 ঈদের কেনাকাটায় গ্রামের মানুষ কেন শহরমুখী হচ্ছেন না সেটা জানার জন্য কথা হয় কয়েকজন কৃষক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মাঝিহট্ট ইউনিয়নের মোড়াইল গ্রামের মশিউর রহমান জানান, ঈদে বিবাহিত তিন বোনের জন্য শাড়ি এবং মা-বাবার জন্য নতুন কাপড় কেনার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু ধানের দাম কম হওয়ায় তা আর সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমি ৩ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। দুই বিঘা জমির ধান বিক্রি করতে হয়েছে খরচ মেটাতে। বাকি এক বিঘা জমির মধ্যে অর্ধেক ধান রেখেছি ঘরের খাবার হিসেবে আর বাকি অর্ধেক বিক্রির কিছু টাকা হাতে রাখতে পেরেছি। কিন্তু তাতেও ঈদের কেনা কাটা হবে না জেনে স্থানীয় একটি সমিতি থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে এবার উপজেলা সদরের মার্কেট থেকে কিছু কেনার চেষ্টা করবো। একই এলাকার কৃষক  গোলাম রব্বানী গোলাপ বলেন, একেতো ধানের দাম কম, তার ওপর আমি ফলনও কম পেয়েছি। সে কারণে এবার আমার বাড়িতে ঈদের কেনা কাটা হচ্ছে না। সামান্য কিছু লাচ্ছা সেমাই কিনে নিয়েই ঈদ করতে হবে।’