আমাদের মা জননী-৫
রাসূল সাঃ মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে চাইলেন
[গতকালের পর থেকে পড়তে হবে]
আমাদের হৃদয় মাঝে বসে আছেন প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা:। নবীর প্রতি আমাদের প্রেম ভালোবাসা জেগে থাকবে আজীবন। আমরা আজো তাঁর ভক্ত হয়ে গেয়ে যাই গান- “ও মদিনার বুলবুলি, তোমার নামের ফুলগুলি; যতন করে হৃদয় মাঝে, একা একা নিরিবিলি; সেই ফুলেরই পাপড়িগুলো ঝরে পড়ে না, মুগ্ধ করা সুবাস তাহার, তবু শেষ হয় না; সেই সুবাসে ব্যাকুল হয়ে গাই তোমারি গীতালি।” প্রিয় নবীকে নিয়ে এমন ছন্দমালা-কবিতা প্রতিদিন লিখে যায় কত শত মুসলমান। সেই নবীর গ্লানিকর মুখোচ্ছবি মনোভূবনে এলে এক তীব্র আর্তনাদে বুক ফেটে যায়। মোনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কুচক্রে রাসূল সা: এর ইজ্জতের ওপর যে আঘাত এসেছিলো, সেই চিত্র কল্পনা করা মাত্রই মুসলমান মন বিবাগী হয়ে যায়।
মানসিক যন্ত্রণা লাঘবের জন্যে রাসুল সা: নিজ স্ত্রীর বিরুদ্ধেই তদন্ত করলেন। কোনো সাক্ষ্য দাতাই হযরত আয়েশা রা: এর বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করলো না। ঘটনার কোনো বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেলো না বলে রাসূল সা: মজজিদে নববীতে গিয়ে ভাষণ দিলেন। নিজের মানসিক যন্ত্রণা-অস্থিরতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে উপস্থিত মুসলমানদের কাছে কাতর নিবেদন জানালেন। একজন সাহাবি দাঁড়িয়ে এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানালেন। কিন্তু অপর একজন মুসলমান সেটার বিরোধিতা করলেন। তাঁকে অন্ধ গোত্রপ্রীতি দলপ্রীতির ব্যাধি পেয়ে বসলো। মসজিদের ভেতরেই দুপক্ষের মধ্যে হট্টগোলের সৃষ্টি হলো। মদীনার আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয় যেনো পুরনো শত্র“তায় ফেরত যেতে চাইলো। মোনাফেকী ষড়যন্ত্রের ছোঁবলে মদিনার মুসলমান সমাজ এক প্রকার গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। অবশেষে রাসূল সা: এর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এ ঘটনারই পূর্ণ কাহিনী হযরত আয়েশা রা: এর নিজ মুখে শোনা গেলে তা আরো পরিষ্কারভাবে জানা যাবে।
হযরত আয়েশা রা: বলেনঃ “(আমার চরিত্র সম্পর্কে অপবাদ দেয়ার) এ ঘটনার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলো না বলে ঐ দিনই রাসূল সা: মুসলমানদের উদ্দেশ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার জন্যে সন্ধ্যার পূর্বে মসজিদের মেম্বরের উপরে উঠলেন। তিনি চাইলেন যে, (মোনাফেক সরদার) আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের (অপপ্রচার চালানোর) কাজের বিষয়ে কেউ কিছু বলুক। রাসূল সা: এবারে সুস্পষ্টভাবে বললেন, “হে মুসলমানরা! এক ব্যক্তি আমার পরিবারের (স্ত্রীর) ওপর মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাকে যারপর নাই কষ্ট দিচ্ছে। তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আমাকে তার অনিষ্ট হতে রক্ষা করবে? শোনো তোমরা! আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমার পরিবার (স্ত্রী) সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই, তার সম্পর্কে আমি ভালো ছাড়া আর কিছুই জানি না। আর ওরা এমন ব্যক্তির (সাফওয়ান ইবনে মোয়াত্তাল-এর) কথা বলাবলি করছে, যার সম্পর্কে এ পর্যন্তভাল ছাড়া মন্দ বলার মতো আমি কিছু পাইনি। সে আমার সাথে ছাড়া (আমার অনুপস্থিত সময়ে) তো কখনো (একা একা) আমার ঘরে প্রবেশ করেনি।”
রাসূল সা: এর এ কথা শুনে হযরত উসয়েদ ইবনে হুযায়ের রা: ( অন্য বর্ণনা মতে হযরত সা’দ ইবনে মু’আয রা:) দাঁড়িয়ে যান এবং বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল সা:! আমি প্রস্তুত রয়েছি। সে যদি আমাদের আওস গোত্রের লোক হয় তাহলে আমি এখনই তার মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। আর যদি সে খাযরাজ বংশের ভাইদের মধ্যকার লোক হয়, তাহলে আপনি নির্দেশ দিন, আমরা আপনের নির্দেশ পালনে কোনোই ত্র“টি করবো না।” তাঁর এ কথা শুনে হযরত সা’দ ইবনে উবাদা রা: দাঁড়িয়ে যান। তিনি খাযরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন। তিনি খুব সৎ লোক (এবং খুব নেক চরিত্রের ও নিষ্ঠাবান মুসলমান ) ছিলেন । কিন্তু হযরত উসায়েদ ইবনে হুযায়ের রা: এর ঐ সময়ের ঐ উক্তির কারণে তাঁর গোত্রীয় মর্যাদায় আঘাত লাগে। (যেহেতু মোনাফেক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ছিলো তাঁরই খাযরাজ গোত্রের লোক) তাই তিনি ওর (আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের) পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে হযরত উসায়েদ ইবনে হুযায়ের রা: সম্বোধন করে বললেন, “তুমি মিথ্যা বললে। না তুমি তাকে হত্যা করবে, না তুমি তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে। সে যদি তোমার গোত্রের লোক হতো, তাহলে তুমি তার নিহত হওয়া কখনও পছন্দ করতে না।” তাঁর (হযরত সা’দ ইবনে উবাদা রা: এর) এ কথার জবাবে হযরত উসায়েদ ইবনে হুযায়ের রা: তাঁকে বললেন, “হে সা’দ ইবনে উবাদা! আপনি মিথ্যা বললেন। আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করবো। আপনি মুনাফিক বলেই মুনাফিকের পক্ষপাতিত্ব করছেন।” তখন আওস ও খাযরাজ গোত্র একে অপরের বিরুদ্ধে মোকাবেলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়। রাসূল সা: এর উপস্থিতিতেই আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়। রাসূল সা: মেম্বরের ওপর থেকেই তাদেরকে থামাতে থাকেন। অবশেষে উভয়দল নিরব হয়ে যায়। রাসূল সা: নিজেও নিরবতা অবলম্বন করেন এবং মিম্বর থেকে নেমে আসেন।”
[পরবর্তী অংশ আগামীকাল]