আমাদের মা জননী-৬

আয়েশা রাঃ একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা করলেন

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ২৭ মে ২০১৯ ১৯:৩২ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩২৫ বার।

[গতকালের পর থেকে পড়তে হবে]
মোনাফেকদের ষড়যন্ত্র যে কত ভয়ংকর কত বিষময় হয় তা আয়েশা রা: কে ঘিরে তাঁকে অপবাদ দেয়া সংক্রান্ত কাহিনীর প্রতি পদে পদে উলব্ধি করা যায়। রাসূল সা: মসজিদে মুসলমানদের উদ্দেশ্য ভাষণে সমস্যার সমাধানের লক্ষে যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা গোত্রপ্রীতি ও বংশীয় মর্যাদার আনুকূল্যের কারণে সম্ভব হয়ে উঠলো না। মুসলমান সমাজে বিভেদ রেখার দেয়াল স্থায়ীভাবে গড়ে উঠার আগেই রাসূল সা: আরো একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। এবার তিনি শ্বশুরালয়ে গিয়ে পারিবারিক বৈঠক করলেন, আয়েশা রা: এর সাথে সামনা সামনি তাঁর বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে আলোচনা করলেন। এমন নাজুক পরিস্থিতি হযরত আয়েশা রা: কিভাবে মোকাবিলা করলেন তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। সীমাহীন দু:খ কষ্টকে সাথে নিয়ে তিনি চরম ধৈর্য্য ধারণ করলেন। তিনি সত্য ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা করলেন। একজন নারী হিসাবে, একজন উচ্চ বংশীয় ঘরের মেয়ে হিসাবে, মুহাম্মাদ সা: মতো একজন মহামানবের স্ত্রী হিসাবে-সেই বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যে কত কঠিন-দু:সাধ্য তা সামাণ্য একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যায়। হযরত আয়েশা রা: যেভাবে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলা করলেন সেই কাহিনী তাঁর নিজ জবানিতেই ফুটে উঠেছে। মসজিদে হট্টগোলের মধ্য দিয়ে ঘটনার যখন সমাধান হলো না, তার পরের ঘটনাসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত আয়েশা রা: বলেন- 
“এইতো ছিলো সেখানকার (মসজিদের) ঘটনা। সেদিন সারাটা দিন ধরে আমি কাঁদলাম। এক মুহূর্তের জন্যেও আমার অশ্র“ থামেনি। আর সারারাত ধরে আমি চোখে একটুও ঘুমের সুরমা লাগাইনি। এর পরের রাত্রিতেও আমি বিনিদ্র রজনি যাপন করলাম। তারপর সকালে আমার আব্বা-আম্মা আমার কাছে এলেন। তাঁরা ধারনা করলেন যে, এই কান্না আমার কলিজা ফেঁড়েই ফেলবে। বিষণœ মনে আমার পিতা-মাতা আমার নিকট বসেছিলেন এবং আমি কাঁদছিলাম। এমন সময় আনসারদের মধ্য থেকে এক মহিলা ভেতরে আসার অনুমতি চাইছিলো, তাঁকে অনুমতি দেয়া হলো, সে ঢুকেই আমার সাথে বসে কাঁদতে শুরু করলো। এ সময় পুরো দুটো রাত ও একদিন আমার কাঁদতে কাঁদতে কেটে গেছে। 
আমাদের কান্নাকাটি চলছিলো। এমন সময় আমাদের কাছে রাসূল সা: হাজির হলেন। তিনি বসলেন। অথচ যখন থেকে এসব (রটনার) কথা বলাবলি শুরু হয়েছিল, তখন থেকে একটি দিনের সামাণ্য কিছু সময়ের জন্যেও তিনি আমার কাছে বসেননি। আর পুরো একটি মাস কেটে গেছে, এর মধ্যে আমার সম্পর্কে কোনো ওহীও আসেনি। (যাহোক,) রাসূল সা: (আমার সামনে) বসে কালেমায়ে শাহাদত পড়লেন। তারপর বললেন, “শোনো! তোমার সম্পর্কে আমার কানে এই (অপবাদের) কথা পৌঁছেছে। তুমি নির্দোষ থাকলে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তোমাকে দোষমুক্ত ঘোষণা করবেন। আর যদি তুমি কোনো দোষে জড়িত হয়ে থাকো, তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাওবাহ করো। কারণ বান্দা যখন কোনো পাপ কাজে লিপ্ত হবার পর তা স্বীকার করে আল্লাহর দিকে ঝুকে পড়ে ও তাঁর কাছে ক্ষমা চায়, তখন তিনি তাকে ক্ষমা করেন। রাসুল সা: এটুকু বলার পর নিরব হয়ে যান।
রাসূল সা: যখন কথা শেষ করলেন তখনও আমার অশ্র“ ঝরছিলো। অবশেষে অশ্র“ শেষ হয়ে গেলো। চোখে একফোটা অশ্র“ও আর রইলো না। তখন আমি আমার আব্বাকে (হযরত আবু বকর রা: কে) বললাম, “আব্বা, রাসূল সা: যা বললেন, আপনিই আমার পক্ষ থেকে সেটার জবাব দিন।” আব্বা বললেন, “আল্লাহর কসম! রাসূল সা: কে আমি যে কী বলবো তা বুঝতে পারছি না।” তখন আমি আম্মাকে বললাম, “আম্মা! রাসূল সা: যা বললেন, আমার পক্ষ থেকে আপনিই সেটার (একটু) জবাব দিন না!” আম্মা বললেন, আল্লাহর কসম! আমি রাসূল সা: কে যে কী উত্তর দিবো, সেটার তো কোনোই দিশা পাচ্ছি না।”
(অতঃপর) তখন আমি নিজেই জবাব দিতে শুরু করলাম। (তখন) আমার বয়স তো বেশি ছিলো না এবং কোরআন আমার বেশি মুখস্থ ছিলো না। আমি (রাসূল সা: ও আমার আব্বা-আম্মার উদ্দেশ্যে) বললাম, “আল্লাহর কসম! আমি জানি, মানুষ যা বলাবলি করছে তা আপনারা শুনেছেন, কথাগুলো আপনাদের মনেও দাগ কেটেছে এবং আপনারা বিশ্বাসও করেছেন। এখন আমি যদি আপনাদেরকে বলি, আমি এই বেহায়াপনা কাজ হতে সম্পূর্ণ মুক্ত, আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি আপনাদের কাছে এমন একটা (বানোয়াট) দোষের কথা স্বীকার করে নিই, তবে আপনারা আমার কথা ঠিক বলে ধরে নিবেন। অথচ আমি আদৌ তা করিনি এবং আল্লাহ তায়ালাও জানেন যে, আমি নিষ্পাপ। এই সময় আমি হযরত ইয়াকুব আ: এর নাম স্মরণ করতে চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু তা স্মরণে আসলো না। (তখন আমি এভাবে বললাম) এখন আমার ও আপনাদের দৃষ্টান্ত তো ইউসুফ আ: এর পিতার (ইয়াকুব আ: এর) মতো। একবার সেই ঘটনাটা স্মরণ করুন। তিনি (ইয়াকুব আ:) বলেছিলেন, “সুতরাং (আমি) সুন্দরভাবে সবর করছি (ধৈর্য্য ধরছি), আর যা কিছু তোমরা বলছো, সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাই আমার একমাত্র সাহায্যকারী। -সূরা ইউসুফঃ ১৮।” এরপর আমি ঘুরে বসলাম ও অপর দিকে পাশ ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।”  

[পরবর্তী অংশ আগামীকাল]