ঠাকুমা

অসীম কুমার কৌশিকঃ
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৪:৫৩ ।
শিল্প ও সাহিত্য
পঠিত হয়েছে ৮১৮ বার।

গ্রামের নাম বাঙালীপুর। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঙালী নদীকে কেন্দ্র করে গ্রামটি গড়ে উঠেছে।তাইতো গ্রামের নামকরণও হয় নদীর নাম অনুসারে।ছোট্ট হলেও প্রকৃতি যেনো নিজ হাতে সাজিয়েছে গ্রামটি।চারিদিকে সবুজ আর সবুজ আহা! চোখ যেন এভাবেই তাকিয়ে থাকতে চায় আজীবন।মন প্রাণ একদম জুড়িয়ে যায়।সন্ধ্যা হলে গ্রামটি যেন আরও অপরুপ হয়ে উঠে।গাছে গাছে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ, আজানের শব্দ,তুলশী তলায় ধূপের গন্ধ,হিমেল হাওয়ায় নদীর কলকল শব্দ সব আয়োজন সৃষ্টিকর্তার জন্য।তাইতো প্রকৃতির এই অপরূপ সাজ।এরই মাঝে ছোট্ট ছোট্ট বাড়িঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে বসতি।প্রকৃতি স্বভাবতই সঙ্গী চায়,যেটা দীনু ও তার দল পূরণ করেছে।


৭-৮ বছরের দীনু যেমন সরল তেমনি দূরন্ত তার দুষ্টুমি। জন্মের সময় সে মাকে হারিয়েছে।ঠাকুমা তাকে খুব ভালোবাসে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয় নি।তাইতো দীনু মাঝে মাঝে ঠাকুমার সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে ঠাকুমা সাজে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে এখন তুমি দীনু আর আমি তোমার ঠাকুমা।তখন ঠাকুমা হাসতে হাসতে ঠাকুমার বাধ্য নাতির মতো অভিনয় করে।তাই দেখে দীনুর সে কি হাসি, হাসতে হাসতে সে দৌড়ে চলে যায়। দীনুর গায়ে দেওয়া সাদা কাপড়টা নিয়ে ঠাকুমা তাকিয়ে থাকে দীনুর দৌড়ানো পথের দিকে।দুচোখে তখন ভাসে দীনুর মায়ের মুখ।দীনুটা একদম ওর মায়ের মতো অইছে। মনে মনে বার বার বলতে থাকে ঠাকুমা।দীনুর বাবা নিশিকান্ত মহন্ত। বাজারে একটা চায়ের দোকানে কাজ করে।নিজের জমিজমা নাই।অন্যের জমিতে চাষ করে যা পায়, আর চায়ের দোকান থেকে যা পায় তাই দিয়ে চলে ওদের তিনটি জীবন।সারাদিন এদিক সেদিক খেলাধুলা,নদীর পাড়ে ঘুড়ি উড়ানো এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে দীনু।আরেকটি কাজে বেশ পটু দীনু ও তার দল।গ্রামের সুস্বাদু ফলগুলোর সাথে ওদের বন্ধুত্ব অনেক দৃঢ়।তাইতো গাছের নতুন ফল সবার আগে ওদের পেটেই যায়।এজন্য অবশ্য মাঝে মাঝেই ওদের দৌড়ও দিতে হয়।সন্ধ্যা নামলেই দীনু যেখানেই থাকুক না কেন বাড়ী ফিরে আসে।না এসে যে উপায় নেই,ঠাকুমার মুখে কিচ্ছা কাহিনী না শুনলে তার ঘুমই আসে না।প্রতিদিনের মতো আজও দীনু বাড়ী এসে দেখে ঠাকুমা উঠোনে তুলশী তলায় ধূপ-প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজো করছে।অমনি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠে 'ঠাকুমা খেতে দাও'। 

ঠাকুমা এতো বাড়ন করেছে ওকে যে পূজো করার সময় এভাবে ধরিস না,বাইরে বাইরে সারাদিন ঘোরাঘুরি করিস হাত-পা না ধুয়ে এভাবে ধরলে যে ঠাকুর পাপ দেবে।কিন্তু কে শোনে কার কথা দীনু বাবু প্রতিদিন ঠাকুমার মুখে এই কথাগুলোই শোনে।পূজো শেষ করে ঠাকুমা দীনুকে খেতে দেয়।এতো তাড়াতাড়ি খাওয়ার কারণ হলো কিচ্ছা শুনতে শুনতে রোজ দীনু ঘুমিয়ে পরে।এজন্য ঠাকুমা বলেছে যে কিচ্ছা শোনার আগে খেতে হবে নইলে কিচ্ছা শোনাবে না।তাইতো এই একটি ব্যাপারেই এতো বাধ্য দীনু বাবু।ঠাকুমা আদর করে মাঝে মাঝেই 'দীনু বাবু' বলে তার সাত রাজার এই ধনকে।আজ খাইয়ে দিতে দিতে ঠাকুমা দীনুর মাথায় হাত বুলায় আর বলে একন তো বড় অইছো দীনু বাবু তাও খাইয়ে দিতে হয়।তুমি না খাওয়াইলে যে প্যাড ভরতে চায় না ঠাম্মা।ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে ঠাকুমা।


আজ দীনুর খেলার সাথীরাও এসেছে কিচ্ছা শুনতে। মাঝে মাঝেই আসে। যদিও এজন্য যথেষ্ট বকাও খায় ওরা মা- বাবার কাছে।এইতো সেদিন দীনুর এক বন্ধুকে কি মারটাই না দিলো ওর মা। পড়াশুনা বাদ দিয়ে কিচ্ছা শুনতে যাওয়া,ফের যদি দেখছি অই বুড়ির কাছে যাওয়া।তবুও এদের আটকাতে পারে না। পড়াশুনার চেয়ে কিচ্ছা শোনার নেশাটা এদের অনেক বেশি। গ্রামের স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে সবাই।দীনুসহ এরা সবাই স্কুল ফাকি দিতে বেশ পটু। উঠানে ঠাকুমার দুই পাশে বসে কিচ্ছা শুনছে দীনু আর তার বন্ধুরা। দীনু শুধু ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে সামনে পা দুটো ছড়িয়ে। সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ঠাকুমা।মাতৃত্বের বন্ধনকেও যেনো হার মানায় এ বন্ধন, তাইতো মায়ের অভাব আজ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি দীনু।ঠাকুমা রোজ এদের অনেক কিচ্ছা,ধাধা শোনায়।আজ সবাইকে একটা রাক্ষসীর কিচ্ছা শোনাচ্ছে ঠাকুমা।হাউ মাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ,হাউ মাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ।গল্পের মাঝে দুহাত নেড়ে নেড়ে এমন ভাবে বলতে থাকে ঠাকুমা।


সবাই ভয়ে চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকে।নিশিকান্ত(দীনুর বাবা) এসেছে বাজার থেকে। সকলেই বাড়ি ফিরে যায়।এক বাড়ি পরেই ওদের সবার বাড়ি।দীনু কিচ্ছা শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে কেউ টের ই পায় নি।এতটাই গভীর মনোযোগ ছিলো সবার।দূর্ভাগ্যের বিষয় পড়াশুনায় ঠিক এর উল্টো ঘটনা ঘটে।ও নিশি বলি ছেলেটাকে একটু বিছানায় শুয়ে দিয়ে আয় বাবা।আমি তোর জন্যে ভাত বারি বলে রান্নাঘরের দিকে যায় ঠাকুমা।নিশিকান্তকে ঠাকুমা নিশি বলে ডাকে।নিশিকান্তের এটা রোজকার কাজ।দীনুর কপালে একটা চুমু দিয়ে কোলে নিয়ে বিছানায় রেখে খেতে আসে নিশিকান্ত।ও নিশি এবার একটা বিয়ে কর বাপ আমারো যে শরীলডা ভালো যাচ্ছে না।ক দিনই বা আর আছি।দীনুটা যে একেবারে একা হইয়া যাইবো তখন।বলে চোখের পানি মুছতে থাকে ঠাকুমা। খাওয়া শেষে চুপচাপ উঠে গিয়ে দীনুর ঘুমিয়ে পড়া কোমল মুখখানির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে নিশিকান্ত।সকাল থেকেই আজ প্রচন্ড বৃষ্টি। ছাতা নিয়ে বেড়িয়ে গেছে নিশিকান্ত। তবুও দোকানে যেতে যেতে প্রায় পুরো ভিজে গেছে।ও দীনু উঠ দেখ কত বৃষ্টি হচ্ছে,তোর পছন্দের মাসকালাইয়ের খিচুড়ি রানছি।অমনি চোখ মেলে ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলো দীনুবাবু।ছাই দিয়ে তাড়াতাড়ি দাঁত মেজে খেতে বসল। 


নিশিকান্তের খাওয়া থালটি সরিয়ে নিজের থালাটি নিয়ে খাওয়া শুরু করলো দীনু।ঠাকুমাও খেতে বসলো দীনুর সাথে।বৃষ্টি থামলো সেই বিকেলবেলা। নদীর পাড়ে একা একা বসে আছে দীনু।নদীর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু নদীর পানির কলকল শব্দে বয়ে চলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।পেছনে কখন যে ঠাকুমা এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি দীনু।মাঝে মাঝেই এখানে এসে বসে থাকে দীনু যখন তার মনটা খারাপ থাকে।তাইতো কোথাও খুঁজে না পেয়ে এখানে এসেছে ঠাকুমা।দীনুর কাধে হাত রাখলো ঠাকুমা।এ যে ঠাকুমার হাত ছাড়া কারো হাত না এটা খুব ভালো করেই জানে দীনু।সন্ধ্যা হয়ে আসছে চল বাড়িতে চল।বলে দীনুকে নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে ঠাকুমা।আজ ঠাকুমা দীনুকে অনেক কিচ্ছা শোনায়।ঘুমিয়ে পড়ে দীনু।

সকাল থেকেই অনেক লোকজনের ভীড় আজ দীনুদের বাড়িতে।দীনু ও তার বন্ধুরা ঠাকুমার কাছে বসে আছে।দীনুর বাবাও বসে আছে।সবার চোখের ভাষা আজ এক। রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছিলো কান্নার রোল শুনে উৎসুক হয়ে বাড়িতে আসে ঘটনা জানার জন্য।এসে তুলসীতলায় ঠাকুমার সরল মুখখানা দেখে আফসোস করতে করতে চলে যায়। কেউবা কিছুক্ষণ থেকে যায় শান্তনা দেবার জন্য।বেচারা দীনু ঠাকুমার গলা ধরে আছে এখনো।অবশেষে সৎকার হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।বাড়িটা কেমন ফাকা ফাকা হয়ে গেছে।


এতদিনে বাড়িটাকে প্রাণহীন মনে হচ্ছে। দীনুর বন্ধুরা চলে গেছে একটু আগেই কিন্তু দীনু এখনো বসে আছে উঠানে এই আশায় যে ঠাকুমা এসে তাকে কিচ্ছা শোনাবে।নিশিকান্ত বারান্দায় বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দীনুর দিকে। হয়তো ঠাকুমার সেদিনের কথাগুলো মনে মনে জাল বুনছে।একটু পর দীনুকে নিয়ে ঘরে যায় নিশিকান্ত। সকালে ঘুম থেলে উঠে দীনুকে না দেখে চমকে উঠলো নিশিকান্ত। খুঁজতে লাগলো চারদিকে।অবশেষে দেখতে পেলো ঠাকুমাকে যেখানে পুতে রাখা হয়েছে সেখানে একটা সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে কি যেনো বলছে দীনু।


একটু এগিয়ে যেতেই শুনতে পেলো,ও ঠাকুমা এই দেখো আমি ঠাকুমা সেজেছি তুমি দীনু সাজো এবার।ও ঠাকুমা দীনু সাজো বলে কাঁদতে কাদতে মাটিতে বসে পড়লো দীনু।নিশিকান্ত এসে দীনুকে কোলে করে বাড়ীতে নিয়ে গেলো।বেশ কিছুদিন কেটে গেলো।দীনু প্রতিদিনের মতো আজও ঠাকুমাকে যেখানে পুতে রাখা হয়েছিলো সেখানে গেলো।বেশ পরিবর্তন হয়েছে জায়গাটার। অনেক ঘাস লতাপাতায় ঢেকে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতে নদীর পাড়ে এসে বসে পড়ে দীনু।ঠাকুমার সমাধির মতো তাদের বাড়িতেও বেশ পরিবর্তন হয়েছে।দীনুর মা এসেছে।দীনুর কথা চিন্তা করে নিশিকান্ত আবার বিয়ে করে।আগের দীনগুলো দীনুর মনে ভেসে উঠে সন্ধ্যায় কিচ্ছা শোনা,বৃষ্টিতে ঠাকুমার হাতের মাসকালায়ের খিচুড়ি।নদীর পাড়ে বসে থাকলে কাধে ঠাকুমার হাতের স্পর্শ।

আজ দীনুকে কেউ নদীর পাড় থেকে ডেকে নিয়ে যায় না বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায় তবুও না।দীনু আজও শিরশিরে বাতাসে তার কাধে ঠাকুমার হাতের স্পর্শ পায়।এভাবেই তাই রোজ সে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীর পাড়ে এসে বসে থাকে।নদীর কলকল শব্দে সে ঠাকুমার কিচ্ছা শুনতে পায় আর বাতাসের স্পর্শে ঠাকুমার ছোঁয়া। ঠাকুমা দীনুর মায়ের অভাব পূরণ করেছিলো। কিন্তু মা ঠাকুমার অভাব পূরণ করতে পারবে কি!