আমাদের মা জননী-৭

আল্লাহ সত্য প্রকাশ করে দিলেন

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ২৯ মে ২০১৯ ১২:২১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩৪২ বার।

[গতকালের পর থেকে পড়তে হবে]
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা তাহেরা রা:-এর প্রতি অপবাদ দেয়ার অপচেষ্টার ঘটনার শেষ অঙ্কের দৃশ্য চরম উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় ঠাসা। ভীষণ রকমের স্নায়ুবিক উত্তেজনার মাঝে স্বামী মুহাম্মাদ সা:, বাবা-মা আবু বকর রা: ও উম্মে রূমান রা: এবং তাঁর মধ্যে চলমান বৈঠকের আলাপচারিতা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এরপর প্রচণ্ড মনোকষ্ট নিয়ে মোমেন কুলের মা জননি হযরত আয়েশা রা: বিছানায় গিয়ে অপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। ব্যথাতুর মন নিয়ে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণের জন্যে একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা করে চললেন। তিনি বারবার এটাই মনে করতে থাকলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সত্য প্রকাশ করে দিবেন। চরম নাটকীয়তার মধ্যে এক সময় আল্লাহ তায়ালা সত্য প্রকাশ করে দিলেন। মোনাফেকদের সকল অপপ্রচার ষড়যন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেলো। আর ইফক এর সেই ঘটনার যবনিকাপাত হলো। যেভাবে উত্তেজানাপূর্ণ ঘটনাটির পরিসমাপ্তি ঘটলো সেই কাহিনীর বিবরণ হযরত আয়েশা রা: এর নিজ যবানিতেই শোনা যাক। হযরত আয়েশা রা: বলেন- 
“আল্লাহর শপথ! আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যে, যেহেতু আমি পবিত্র ও দোষমুক্ত, সেহেতু আল্লাহ তায়ালা আমার দোষমুক্ত থাকার কথা স্বীয় রাসূল সা: কে অবহিত করবেন। কিন্তু আমি এটা কল্পনাও করতে পারিনি যে, আমার ব্যাপারে কোরআনে আয়াত নাযিল হবে, আর তা কেয়ামত পর্যন্ত পড়া হবে। আল্লাহ নিজে আমার সম্পর্কে কথা বলবেন- এতদূর সৌভাগ্য আমার হবে তা কখনো কল্পনা করতে পারিনি। আমি (বরং) মনে করেছিলাম যে, রাসূলে করিম সা: কোনো স্বপ্ন দেখবেন এবং তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ আমার নির্দোষিতা প্রকাশ করে দিবেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! আল্লাহর কসম, তখনও রাসূল সা: নিজের জায়গা থেকে সরেননি (সেই বৈঠকও শেষ হয়ে পারেনি) এবং বাড়ির কোনো লোকও বাড়ি হতে বের হননি। এমতাবস্থায় নবী করিম সা: এর ওপর ওহী নাযিলের সময়কালীন অবস্থার চিহ্ন ফুটে উঠলো। তাঁর ললাট হতে পবিত্র ঘামের ফোঁটা টপ টপ করে পড়তে লাগলো। কঠিন শীতের সময়েও ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় সেটার গুরুভারের কারণে ঐ অবস্থায়ই প্রকাশ পেতো। এ অবস্থা দেখে আমরা সব চুপ হয়ে গেলাম। আমি তো মনে মনে পূর্ণ মাত্রায় নির্ভয় ছিলাম। কিন্তু আমার পিতা-মাতার অবস্থা ছিলো এতই মর্মান্তিক যে, রাসুলে সা: এর ওপরে ওহী নাযিলের সময়কাল পর্যন্ত ভয়ে তাঁদের যেন প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছিলো। আল্লাহ কোন্ সত্য উদঘাটিত করেন, সেই চিন্তায় তাঁরা ছিলেন উদ্বিগ্ন।

ওহী নাযিলের সময়কালীন অবস্থা যখন নিঃশেষ হয়ে গেলো, তখন রাসূলে করিম সা: কে বেশ উৎফুল্ল দেখা গেলো। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে গেলো। খুশিতে তাঁর দাঁতের ফাঁকগুলো পর্যন্ত দেখা গেলো। তিনি তাঁর ললাটের ঘাম মুছতে মুছতে এসময় প্রথম কথাটিই আমার প্রতি বললেন। তিনি আমাকে বললেন, “ওহে আয়েশা! আল্লাহর প্রশংসা করো, তাঁর শোকর আদায় করো। আল্লাহ তোমার নির্দোষ হওয়ার কথা নাযিল করেছেন।” অতঃপর নবী করিম সা: দশটি আয়াত পড়ে শোনালেন (সূরা নূর-এর ১১-২০নং আয়াত পর্যন্ত)। তাৎক্ষণাত আমার মা আমাকে বললেন, “হে আমার প্রিয় কন্যা! আল্লাহর রাসূল সা: এর সামনে দাঁড়িয়ে যাও।” আমি উত্তরে (কৃত্রিম অভিমানের ছলে) বললাম, “আল্লাহর শপথ! আমি তাঁর সামনে দাঁড়াবো না এবং মহান আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকট কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করবো না। তিনিই আমার দোষমুক্তি ও পবিত্রতার আয়াত নাযিল কররেছেন।”
এভাবেই মোমেনকুলের মা হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা: আল্লাহ কর্তৃক পবিত্র ঘোষিত হলেন। এরপর থেকে হযরত আয়েশা রা:-এর নামের সাথে তাহেরা (পবিত্রতা) উপাধি যোগ হয়ে গেলো।
হযরত আয়েশা রা: এর চরিত্র নিয়ে মোনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই যে অপপ্রচার- ষড়যন্ত্র-গণ্ডগোলের সৃষ্টি করলো সেটার তিনটি উদ্দেশ্য ছিলা। সে এক ঢিলে তিনটি পাখি শিকার করতে চেয়েছিলো। প্রথমত: সে রাসূল সা: ও তাঁর বিশ্বস্ত সাথী হযরত আবু বকর রা: -এই দুজনেরই ইজ্জতের ওপর হামলা করলো। দ্বিতীয়ত: সে ইসলামী দাওয়াতের সর্বোচ্চ নৈতিক মান, পবিত্রতা ও মর্যাদাকে বিনষ্ট করতে উদ্যোগী হলো। তৃতীয়ত: সে এমন এক অগ্নি স্ফুলিংগ নিক্ষেপ করলো যাতে করে মদিনার মুসলমান ভাইয়েরা পরস্পর কঠিন লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এখানে বলতেই হয় যে, ইসলাম যদি মদিনার মুসলমানদের মনের মধ্যে পরিবর্তন সূচিত না করতো, অর্থাৎ তারা যদি ইসলাম গ্রহণের পূর্বাবস্থার মতো জাহেল থাকতো, তবে এই ঘটনা কতই না সর্বনাশ ডেকে আনতো, আল্লাহর অনুগ্রহে সেদিন মদিনার মুসলমান সমাজ মোনাফেক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো।

[পরবর্তী অংশ আগামীকাল]