ফসল ঘরে তোলার মৌসুমে ঈদ এলেও ধানের দাম কম: কেনাকাটার সামর্থ হারিয়েছেন বগুড়ার কৃষক

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১ জুন ২০১৯ ০৬:১৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৫১ বার।

ধানের কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় এবার বগুড়ায় ঈদের কেনা-কাটায় পিছিয়ে কৃষক। উপজেলা সদর থেকে জেলা শহরে মার্কেটগুলোতে কৃষক এবং তাদের পরিবারের তেমন উপস্থিতি চোখে পড়ছে না। উপজেলা পর্যায়ের মার্কেটগুলোতে প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। আর জেলা সদরে চাকরিজীবী এবং ব্যবসায়ীদের ভিড় উপচে পড়ছে। 
দোকানিদের ভাষ্য, এ অঞ্চলের প্রধান ফসল ধান। সেই ধান ঘরে তোলার মৌসুমে ঈদ আসায় মার্কেটগুলোতে এবার কৃষকের উপস্থিতি বেশি হবে বলেই তাদের ধারণা ছিল। সেই অনুযায়ী তারা কাপড় ও জুতা-স্যান্ডেলসহ অন্যান্য ঈদে প্রয়োজন হয় এমন পণ্যের মজুদ বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু এ বছর ধান বিক্রির টাকায় আবাদের খরচ না ওঠায় সিংহভাগ কৃষক মার্কেটে আসতে পারছেন না। যে কারণে তারাও ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর এক বিঘা (এক একরের ৩০ শতাংশ) জমিতে ধান আবাদে এলাকাভেদে ১২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। মোটা এবং চিকন-এই দুই জাতের ধানের আবাদের খরচ এক হলেও ফলন এবং দামে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এ মৌসুমে প্রতি বিঘায় মোটা জাতের ধানে ফলন এসেছে গড়ে ২২ মণ। আর চিকন ধান মিলেছে ১৮ মণ। মোট জাতের ধানের দর এখন ৫০০ টাকা আর চিকন ধান বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৬৮০ টাকা মণ দরে। সেই হিসাবে এক বিঘা জমিতে মোটা জাতের ধান বেচে কৃষক পাচ্ছে ১১ হাজার টাকা আর চিকন জাতের ধান থেকে আসছে ১২ হাজার ২৪০ টাকা। অর্থাৎ আবাদের খরচই তুলতে পারছেন না কৃষক।
হাট-বাজার ঘুরে জানা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে বোরো ধানের দাম মণপ্রতি ৩৩ শতাংশ কমেছে। গত বছর ঠিক এই সময় চিকন জাতের ধান গড়ে ৯৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। আর এবার সেই একই ধান বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬৮০ টাকা দরে। বাজারে কাঁচা ধানের তুলনায় শুকনা ধানের দাম একটু বেশি হয়। সেদিক থেকেও এবার কৃষক বিড়ম্বনা পোহাত হচ্ছে। কারণ গত বছর ধান ঘরে ওঠার অন্তত ২০ দিন পর ঈদ হওয়ায় কৃষক শুকনা ধান বিক্রি করে কিছুটা বেশি দাম পেয়েছিল। আরবী মাস চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এবার ঈদ ১০ দিন এগিয়ে এসেছে। অথচ জেলার সব অঞ্চলে এখনও ধান কাটাই শেষ হয়নি। কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ ধান ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে। ফলে ভেজা ধানই বিক্রি করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে সরকারিভাবে এবার বাজার দরের চেয়ে প্রায় ৫২ শতংশ বেশি দামে ২৬ টাকা কেজি হিসেবে গড়ে ১ হাজার ৪০ টাকা দরে ধান কেনা হলেও সব কৃষকের ভাগ্যে তা জুটছে না। কারণ জেলায় সাড়ে ৭ লাখ কৃষক বোরো আবাদ করলেও ধান বিক্রির সুযোগ পাচ্ছেন মাত্র ৫ হাজার ৮৮৬ জন কৃষক।
বুধবার জেলার আদমদীঘি হাটে কথা হয় ধান বিক্রি করতে আসা শালগ্রামের আলতাফ আলীর সঙ্গে। নিজের পাঁচ বিঘা জমিতে ধান আবাদের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, গত বছর এই সময় তিনি ৯০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করেছেন। সেই টাকা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য রোজার ঈদের কেনা-কাটা করে কোরবাণীর ঈদেও খরচ করতে পেরেছিলেন। আর এবার দাম কম হওয়ায় ধান বিক্রি করে রোজার ঈদের কেনা-কাটা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। একই উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামের মোকছেদ আলী জানান, ১৫ দিনের ব্যবধানে ধানের দর মণপ্রতি ১০০ টাকা করে বেড়েছে কিন্তু তাতেও লোকসান কমছে না। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও হাটে ধান নিয়ে আসিনি শুধু বাজার দেখতে এসেছি। ধানের দাম বাড়বে এই আশায় আমার মত অনেকে এখন ধান বিক্রি করতে চাইছেন না। তাছাড় শুকনো ধানের দাম ভেজা ধানের চেয়ে কিছুটা বেশি পাওয়া যায়। তাই ঈদের ২/৩দিন আগ পর্যন্ত দেখবো’।
শিবগঞ্জ উপজেলার মাঝিহট্ট ইউনিয়নের মোড়াইল গ্রামের মশিউর রহমান জানান, ঈদে বিবাহিত তিন বোনের জন্য শাড়ি এবং মা-বাবার জন্য নতুন কাপড় কেনার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু ধানের দাম কম হওয়ায় তা আর সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমি ৩ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। দুই বিঘা জমির ধান বিক্রি করতে হয়েছে খরচ মেটাতে। বাকি এক বিঘা জমির মধ্যে অর্ধেক ধান রেখেছি ঘরের খাবার হিসেবে আর বাকি অর্ধেক বিক্রির কিছু টাকা হাতে রাখতে পেরেছি। কিন্তু তাতেও ঈদের কেনা কাটা হবে না জেনে স্থানীয় একটি সমিতি থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি। সেই টাকা দিয়ে এবার উপজেলা সদরের মার্কেট থেকে কিছু কেনার চেষ্টা করবো। একই উপজেলার আলাদিপুর গ্রামের কৃষক বুলু মিয়া ও দেলোয়ার হোসেন জানান, এ বছর ধান আবাদ করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। স্ত্রী ও ছেলে-মেয়দের জন্য ঈদের কেনা-কাটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলার ধুনট উপজেলা সদরের সৌখিন বস্ত্র বিতানের পলান চন্দ্র দাস জানান, ঈদ মৌসুমে আমাদের দোকানগুলোতে কৃষক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিই বেশি থাকে। কিন্তু এবার তাদের চোখে পড়ছে না। গত ৩/৪ বছরের মধ্যে এবার ঈদের বেচা-কেনা একেবারেই খারাপ। মার্কেটে যারা আসছেন তারা মূলত চাকরিজীবী ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। পাশের সোনালি নিউ মার্কেটের নোভা গার্মেন্টস এন্ড ফেব্রিক্স এর মালিক নাজমুন হাসান ও হারুন সু ষ্টোরের হারুনার রশিদ জানান, এবার ধানের দাম না থাকায় ঈদ মর্কেট জমে উঠেনি।
দুপচাঁচিয়া নিউ মার্কেটের মুক্তার গার্মেন্টেস-এর মুক্তার হোসেন জানান, ধানের দাম কম হওয়ায় এবার কৃষক বিশেষত যাদের জমি ৩ বিঘার কম তারা কেনাকাটার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। তবে মার্কেটে প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।
শিবগঞ্জ উপজেলা সদরের ভাই ভাই বস্ত্রালয়ের মালিক মালিক রাজ কুমার ঈদ বাজার মন্দা জানিয়ে বলেন, ‘এবার ঈদের আগে ধান কাটা শুরু হওয়ায় ভেবেছিলাম ব্যাপক কেনা-বেচা হবে। কিন্তু বাস্তবতা পুরো উল্টো। ধানের দাম কম থাকায় কৃষক এবং তার পরিবারের সদস্যদের এমনিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঈদের কেনা-কাটা করবে কোত্থেকে। আর কৃষকরা আ আসায় আমাদের বেচা-কেনাও অনেক কমেছে।’ বগুড়ার সবচেয়ে বড় নিউ মার্কেটের তৈরি পোষাক বিক্রেতা মামুনুর রশিদ জানান, ধানের দাম কম থাকায় এবার রমজানের শুরু থেকেই বেচা-কেনা ছিল না। তবে বিশ রমজানের পর চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা আসছেন বলে কেনা-কাটা কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘ফসল কাটার মৌসুমে ঈদ আসছে বলে এবার একটু বেশিই পোষাক তুলেছিলাম। কিন্তু সেই অনুযায়ী বিক্রি নেই।’