আমাদের মা জননী-১১

ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের কথাগুলো [৩য় পর্ব]

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ০৩ জুন ২০১৯ ০৬:৩৮ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩৪১ বার।

[গতকালের পর থেকে পড়তে হবে] 
আমরা আলোচনা করছি হযরত আয়েশা রাঃ এর চরিত্রের ওপর অপবাদ দেয়ার ঘটনায় (ইফ্ক-এর ঘটনায়) ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের কথাগুলো নিয়ে, মোনাফেকদের কর্মকাণ্ড ও তাদের ষড়যন্ত্র নিয়ে। এই মোনাফেক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আবেশে ধ্বংস হয়ে যায় সমাজ, ধ্বংস হয়ে যায় ব্যক্তি জীবন, ঘুম কেড়ে নেয় শান্তিপ্রিয় মানুষের। মোনাফেকদের  ছোবল বড়ই ভয়ংকর, ভীষণ কষ্টদায়ক। মদিনার মোনাফেক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বিরাট এক স্পর্শকাতর জায়গায় ষড়যন্ত্রের তীর নিক্ষেপ করলো। আর সেই অগ্নিস্ফুলিংগ থেকে দাউ দাউ করে পুড়তে থাকলো সরল প্রাণ হৃদয়গুলো। সেই ভেঙে যাওয়া হৃদয়ের কথাগুলোর লিপিতে বাদ পড়েনি রাসূল সা: এর নাম। হযরত আয়েশা রা: এর চরিত্রের ওপর অপবাদ আরোপের ঘটনায় প্রিয় নবী যারপর নাই কষ্ট পেতে লাগলেন। এক মোনাফেকের ভয়ংকর বিষাক্ত ছোবলে তিনি ছটফট করতে লাগলেন।
মোহাম্মদ সা: তো আল্লাহর রাসূল। তিনি বনু হাশেম গোত্রের শিরোমনি, আল আমীন। মক্কা-মদিনার নয়নমনি, বিশ্বের সেরা মানুষ। মানবকুলের গৌরব। মানুষের ব্যথায় সদা উদ্বেলিত তাঁর কুসুম কোমল হৃদয়। অবহেলিত, নিপীড়িত, দুঃখ-জর্জরিত মানবতার সমস্যা সমাধানে ও দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণে এবং শত্র“তাকে বন্ধুতে রূপান্তরিত করার মানসে তিনি নিজ রূপ যৌবনের চাহিদা ভুলে গিয়ে অসম সকল বিয়েতে রাজী হয়েছেন- সেই মহামানবের ঘরেই প্রবেশ করলো এই নিষ্ঠুর অপবাদের বেদনাদায়ক তুফান। নবী হলেও তিনি তো মানুষ। মানুষের অনুভূতি ও দু:খ বেদনা দিয়েই তো মানুষের মাঝে তাঁকে পাঠানো হয়েছে এবং এভাবে মানুষের দরদ ব্যথা বোঝার ক্ষমতা তাঁকে দেয়া হয়েছে। সুতারাং এ ধরনের অপবাদ কাহিনীতে তিনি তো মানসিক যন্ত্রনায় তাড়িত-পীড়িত হবেনই। আর এ জন্যেই তো সংকট নিরসনের জন্য তিনি হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রা: এবং হযরত আলী ইবনে তালেব রা: কে ডেকে নিয়ে তাঁদের পরামর্শ চাইলেন। তিনি তাঁর কঠিন পেরেশানির মধ্যেই পরামর্শ অনুযায়ী বাড়ির খাদেম (কাজের মেয়েকে) ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। এমনকি অপর স্ত্রী হযরত যয়নব (রা:)-কেও তিনি ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাস করলেন। 
হযরত যয়নব (রা:)ও নিজ সতীন হযরত আয়েশা রা: সম্পর্কে ভালো ছাড়া মন্দ সাক্ষ্য দিলেন না। ফলে রটনার ঘটনার কোনোই প্রমাণ না পেয়ে মোহাম্মদ সা:  ছুটে গেলেন মসজিদে নববীতে। সেখানে তিনি তাঁর মনের কথা ব্যক্ত করলেন, মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাইলেন, নিজ স্ত্রীর পবিত্রতা সম্পর্কে ঘোষণা দিলেন। 
আল্লাহর পরম বন্ধুর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মসজিদে উপস্থিত গোটা মুসল্লিারা গভীরভাবে আঁচ করতে পেরেছিলো। ফলে, যারা রাসূল সা: এর অমার্যাদা করেছে তাদেরকে তারা কঠোরভাবে তিরস্কার করলো এবং ভীষণভাবে নিন্দা-মন্দ করলো। কিন্তু খাযরাজ গোত্রের একজন নেতার মধ্যে গোত্রপ্রীতির দলীয় মোহের আবেশ সঞ্চারিত হলো, তিনি দায়ী ব্যক্তিকে (মোনাফেক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে) হত্যার মতো চরম শাস্তি দেয়ার বিরোধিতা করলেন। মসজিদের ভেতরেই আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মাঝে রোখারুখি হওয়ার অবস্থা তৈরি হলো। সাহাবি  (রা:)-দের সহযোগিতায় রাসূল সা: যে মসজিদ তৈরি করেছিলেন, যে মসজিদ মুসলমানদের প্রধান মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল সেই মসজিদে খুনোখুনি হওয়ার উপক্রম হলো। এরূপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়া, একথারই সাক্ষ্য বহন করে যে, আয়েশা রা: এর প্রতি অপবাদ রটনার ব্যাপারটা গোটা মুসলিম সমাজকে কিভাবে ঝাঁকিয়ে তুলেছিলো, কতবড় ফাটল ধরিয়েছিলো মুসলিম মিল্লাতের নেতৃত্বের মধ্যে। মুসলিম মিল্লাতের এই দ্বিধা বিভক্তিই রাসূল সা: এর হৃদয়কে বেশি বিদীর্ণ করেছিল। 
ইফ্ক-এর ঘটনায় মনে হচ্ছিলো- এতদিন ধরে সত্যের যে মহান বাতি প্রদীপ্ত হয়েছিলো, সেটার প্রভা যেন মোমেনদের অন্তরসমূহের মধ্যে হঠাৎ করেই ম্লান হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিলো সেই সমুজ্জ্বল আলো মানুষকে আর পথ দেখাতে পারছে না। তাই রাসূল সা: ভাবলেন চট জলদিই এর অবসান দরকার, এ জটিল সমস্যার আশু সমাধান নিতান্ত প্রয়োজন। সুতরাং আর কালবিলম্ব না করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আয়েশার কাছে যেতে হবে। সামনা সামনি আলাপ আলোচনা করে শীঘ্রই একটা সমাধানে পৌঁছুতে হবে। আল্লাহর রাজ্যে সকল সমস্যারই সংশোধনী আছে। যদি তাতে ভুল স্বীকার, অনুতাপ ও সংশোধনীর মনোবৃত্তি থাকে এবং হতাশার ইন্ধন না থাকে। অতঃপর তিনি আয়েশা রা: এর কাছে গেলেন। হযরত আয়েশা রা: তো নবী সা: এর প্রিয়তম স্ত্রী, যিনি মহামানব মোহাম্মদ সা: কে নবী বলে মেনেছেন, জেনেছেন। নবী সা: এর হাতে তাঁর জান, মন-প্রাণ সবই অম্লান বদনে সপেঁ দিয়েছেন। এমন স্ত্রীর প্রতিই তিনি গিয়ে সম্বোধন করছেন, ব্যথাহত হৃদয়ে ভাংগা গলায় বলছেন, “তাহলে এখন শোনো! আমার কানে এই কথা পৌঁছেছে, এখন তুমি যদি নির্দোষ হয়ে থাকো, শীঘ্রই আল্লাহ তায়ালা তোমার নির্দোষিতার ঘোষণা দিবেন, আর (শয়তানের ষড়যন্ত্রে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে থাকে) যদি কোনো অপরাধে জড়িত হয়ে থাকো, ক্ষমা চাও মহান আল্লাহর দরবারে এবং তাঁর কাছেই তওবা করো, যখন মানুষ দোষ ত্র“টি করে তা স্বীকার করে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর কাছে তাওবা করে (অনুতপ্ত হৃদয়ে তাঁর কাছেই ফিরে যায় এবং আর এ ধরনের অপরাধ করবে না বলে সর্বান্তকরণে ওয়াদা করে) তখন তিনি অবশ্যই সে তাওবা কবুল করেন।” রাসুল সা: এর এসব হৃদয়ের কথা শোনা মাত্র আমাদের মন বিগলিত হয়ে যায়। নিজ হৃদয়ের মাঝে এক তীব্র ভাবাবেগ তৈরি হয়। এক নিদারুণ দু:খজ্বালা নিবারন করতে, মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনতে কতই না ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে তিনি তাঁর প্রিয়তম স্ত্রী হযরত আয়েশা রা: এর মুখোমুখি হয়ে এসব বলেছিলেন। 
এমনই একপর্যয়ে, যখন ব্যথা-বেদনা, দুঃখ-জ্বালা, মানসিক যন্ত্রণা ও সকল ধরনের মানসিক পেরেশানী চূড়ান্ত    স্তরে পৌঁছে গেলো এবং তাতে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে জড়িত হয়ে পড়লো ব্যক্তি, পরিবার ও গোটা মুসলিম সমাজ তখনই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবীর ওপর মহব্বতের দৃষ্টি দান করলেন এবং সকল অস্পষ্টতার অবসান ঘটিয়ে অমিয়বাণী কোরআনের আয়াত নাযিল করলেন। কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা তাহেরা রা: এর পবিত্রতা ঘোষিত হলো এবং তাঁর দুঃখের ঘনঘটা দূরীভূত হলো। সেই সাথে নবী সা: এর মহান পবিত্র মর্যাদা ঘোষিত হলো। আর সেইসব মোনাফেকদের খোলস খুলে দেয়া হলো যারা অপবাদের এই নাটক রচনা করেছিলো। একই সাথে মহা সম্মানিত নবী সা: এর পক্ষে মুসলমানদের জন্যে সরল, সুন্দর ও বলিষ্ঠভাবে (এ ধরনের পরিস্থিতি) মোকাবেলার পথ খুলে দেয়া হলো।
অন্যদিকে, ইফ্ক এর এই ঘটনা সম্পর্কে কোরআনের আয়াতসমূহ যখন নাযিল হলো, তখন মোমেন কুলের মা হযরত আয়েশা রা: বলে উঠেছিলেন, “আল্লাহর কসম! আমি তো তখনই জানতাম (যে যাই বলুক না কেন), আমি অবশ্যই দোষমুক্ত এবং আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা অবশ্যই আমার নির্দোষিতার ঘোষণা দিবেন, কিন্তু আল্লাহর কসম! এটাও সত্য আমি কশ্মিনকালেও ধারনা করতে পারিনি যে, আল্লাহ তায়ালা আমার জন্যে ওহী নাযিল করবেন এবং তা মানুষের মুখে মুখে কেয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে। আর আমি তো নিজেকে আমার কাছে এতোই তুচ্ছ মনে করি যে, আমার কল্পনাতেও আসে না যে, আমার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা কথা বলবেন এবং তা মানুষ পড়বে (কেয়ামত পর্যন্ত)। বরং আমি এতটুকু মাত্র আশা করেছিলাম যে, রাসূল সা: ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখবেন যে, আমাকে দোষমুক্ত করা হচ্ছে।”

[পরবর্তী অংশ আগামীকাল]