বগুড়ায় আরডিএ’র সাফল্য

যেভাবে দেশী মুরগী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লালন-পালন করবেন

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৫ জুন ২০১৯ ০৫:০৪ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৭১২৩ বার।

ফার্মের মুরগিতে যাদের অরুচি- তাদের জন্য সুখবর এনেছেন বগুড়ার সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) একদল গবেষক। প্রায় দুই বছরের গবেষণায় প্রাকৃতিকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশি মুরগি পালনে তারা সফল হয়েছেন। 
তিন সদস্যের ওই গবেষক দল পরে তাদের প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ১০টি গ্রামে পর্যায়ক্রমে আড়াই শ’ নারীকে দেশি মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ দেন। বাজারে দেশি মুরগির ব্যাপক চাহিদা থাকায় পরবর্তীতে প্রশিক্ষিত ওই নারীদের কাছ থেকে লালন-পালন শিখে এখন অন্য নারীরাও স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। মুরগি ও ডিম বিক্রি করে তারা প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করছেন।
দেশি মুরগি পাওয়া যায়-এমনটা জানার পর শহরের অনেকে এখন আরডিএ’র পাশের গ্রামগুলোতে ছুটতে শুরু করেছেন। তাদেরই একজন শহরের সুত্রাপুরের বাসিন্দা আবাসন ব্যবসায়ী রাজেদুর রহমান রাজু। পনের দিন পর পর তিনি দেশি মুরগি কিনতে এখন শেরপুর উপজেলার রণবীরবালা গ্রামে যান। তার দেখাদেখি পরিচিত বন্ধুরাও ওই গ্রামসহ পাশের কাফুরা, শুবলী ও গোপালপুর গ্রামে যাচ্ছেন দেশি মুরগি কিনতে।
ব্যবসায়ী রাজেদুর রহমান রাজু বলেন, ‘আমি ফার্মের মুরগি খেতে পারি না। বাড়িতে অন্যরাও খেতে চায় না। দেশি মুরগি বাজারেও তেমন পাওয়া যায় না। আর যেগুলো ‘দেশি’ বলে বিক্রি হয় সেগুলো মূলত সোনালী জাতের মুরগি। ফলে মুরগি খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিতে হয়েছিল। যদি কখনও গ্রাম থেকে পরিচিতদের কেউ দিয়ে যেতেন কেবল তখনই দেশি মুরগির স্বাদ নিতে পারতাম। কিন্তু এখন আরডিএ’র গবেষকদের কল্যাণে দেশি মুরগি পেতে সমস্যা হচ্ছে না।’
শুরুটা যেভাবে
আরডিএ’র কৃষি বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক আব্দুল্লাহ্ আল মামুন জানান, ২০১৭ সালে তারা ‘কমিউনিটি ভিত্তিক বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগি পালনের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা শুরু করেন। যার লক্ষ্য ছিল প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীদের দেশি মুরগি পালনে প্রযুক্তিগত জ্ঞান বৃদ্ধি করা, স্বল্প খরচে বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন, কৃত্রিম উপায়ে দেশি মুরগির বাচ্চা ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা, সাধারণ খাদ্যের পরিবর্তে এক মাস বয়স পর্যন্ত সুষম দানাদার খাদ্য প্রদান, নিয়মিতভাবে টিকা ও কৃমিনাশক ওষুধ দেওয়া, মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহারে জৈব্য সার উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ। গবেষক আব্দুল্লাহ্ আল মামুন জানান, গবেষণা কাজে পরবর্তীতে আরডিএর কৃষি বিজ্ঞান বিভাগের সহকারি পরিচালক মাশরুফা তানজীন ও ডা. মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলামকে যুক্ত করা হয়।
গবেষণা দলের সদস্য ডা. মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম জানান, গবেষণার শুরুতে দেশি মুরগি পালনে সমস্যাগুলো কি কি সেগুলো চিহ্নিত করতে তারা গ্রামীণ নারীদের ওপর জরিপ চালান। তাতে দেখা যায়, বাচ্চার মৃত্যুর হার বেশি এবং ওজন বৃদ্ধি হয় খুবই ধীর গতিতে। এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় নজরে আসে সেটি হলো- স্বল্প পরিসরে শুধুমাত্র মা মুরগি দিয়ে (ডিমপাড়া মুরগি) ১২ থেকে ১৫টি ডিম ফুটানো হয়। যে কারণে তাদের পক্ষে বাণিজ্যিকভাবে দেশি মুরগি পালন করা সম্ভব হচ্ছিল না।
সনাতনী পদ্ধতিকে অক্ষুন্ন রেখে যেভাবে মুরগির উৎপাদন বাড়ানো হলো
গবেষক দলের প্রধান আব্দুল্লাহ্ আল মামুন বলেন, বাড়ি-ঘরে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে আমাদের মা-বোনেরা সনাতনি যে পদ্ধতি অনুসরণ করেন সেটিকে অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে আমরা চারটি ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিয়েছি। সেগুলো হলো-বাচ্চা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ডিমগুলো মা মুরগির পরিবর্তে হ্যাচারীতে ফুটানো, এরপর বাচ্চাগুলোকে ব্রুডিং করা অর্থাৎ নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এক থেকে দুই সপ্তাহ রাখা, একই ধরনের খাবার  না দিয়ে সুষম খাদ্য এবং চিকিৎসা অর্থাৎ নিয়মিত টিকা ও কৃমি নাশক প্রদান। এই চারটি পদ্ধতি অনুসরণের ফলে একদিকে যেমন মুরগির মৃত্যুর হার ৩ থেকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে তেমনি ৮৫ থেকে ৯০ দিনে মুরগিগুলোর ওজন ২০০ শতাংশেরও বেশি বাড়িয়ে ৬৫০ থেকে ৭৫০ গ্রামে উন্নীত করা গেছে। এই পদ্ধতিতে বাড়ির ভেতরে-বাইরে, বাগানের মধ্যে এমনকি ছাদে মাত্র ৮০০ বর্গফুট জায়গায় ১ হাজার মুরগী পালন করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমরা আরডিএ’র ইনকিউবেটরে ডিম ফোটায়। একটি ডিম ফোটানোর জন্য আমরা পাঁচ টাকা করে নিয়ে থাকি। এছাড়া আমরা একদিনের বাচ্চাও ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি করি। তবে কেউ কেউ চাইলে ৫০০টি ডিম ফোটানোর জন্য মাত্র ১৫ হাজার টাকায় একটি ইনকিউবেটর বানিয়ে নিতে পারেন।
আরডিএ’র গবেষণা দলের সদস্য ডা. মোহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম জানান, দুই বছর আগে তারা তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে রণবীরবালা গ্রামের ২৫জন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে পরবর্তীতে মাত্র ১০জন নারী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মুরগি পালন শুরু করেন। এরপর তারা যখন সফল হলেন তখন আশ-পাশের গ্রামের নারীরাও দেশি মুরগি পালনে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তিনি বলেন, সবাইকে তো আর আমাদের পক্ষে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়, তাই আমরা প্রত্যেক গ্রামে ১৫জন মহিলার জন্য একজনকে গ্রুপ লিডার বানিয়ে তার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ এবং মুরগি বাজারজাতকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছি।
রণবীরবালা গ্রামের মৃত রইচ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী সুলতানা আহম্মেদ জানান, তিনি প্রথমে আরডিএ থেকে একদিনের ২০টি মুরগির বাচ্চা এনেছিলেন। সেখান থেকে এখন তার প্রায় ২৫০টি মুরগী হয়েছে। তিনি বলেন, যেহেতু বাচ্চাগুলোর মা থাকে না তাই একদিনের বাচ্চাগুলোকে ব্রুডিং অর্থাৎ অন্তত ৭দিন নির্ধারিত তাপে একটি বাক্সের ভেতরে রাখতে হয়। কাক, চিল বা বেজির কবল থেকে রক্ষার জন্য তাদের এক মাস একটি ঘরে রেখেই খাবার দেওয়া হয়। তারপর সেগুলোকে বাড়ির উঠানে ছেড়ে দিয়ে তিন বেলা চালের খুদ, ভুট্টাগুড়া, ঘাস এবং ফিড খাওয়ানো হয়। এর পাশাপাশি নিয়মিত টিকা এবং কৃমিনাশক দেওয়া হয়।
জবা খাতুন নামে এক গৃহবধু জানান, বাচ্চাগুলোর বয়স পাঁচদিন হলে প্রথম টিকা দিতে হয়। এরপর ২১ দিনে এবং এক মাস পরেও টিকা দিতে হয়। দেড় মাসে কৃমিনাশক এবং ২ মাস পর দিতে হয় রাণীক্ষেত রোগের টিকা।
আমিনা খাতুন নামে অপর এক গৃহবধু জানান, দুই বছর আগে মুরগী পালন শুরু করে তিনি এখন প্রতি মাসে অন্তত ২০ হাজার টাকা বাড়তি আয় করছেন। তিনি বলেন, অনেক সময় পাইকারি বিক্রেতারা আমাদের মুরগিগুলো দেশি বলে বিশ্বাস করতে চায় না। তবে আমরা তাদেরকে বাড়িতে এনে দেখালে তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হন এবং ৯০দিন বয়সী একটি মুরগী ৩৫০ টাকা কেজি দরে কেনেন। দিন দিন দেশি মুরগির চাহিদা দেখে আমার মত আশ-পাশের মহিলারও এখন মুরগি পালন শুরু করেছেন।
 আরডিএ’র কৃষি বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক আব্দুল্লাহ্ আল মামুন জানান, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশি মুরগি পালনের এই পদ্ধতি এখন বগুড়ার পাশাপাশি সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা এবং রাজবাড়ি জেলাতেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এটিকে আরও বড় আকারে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। এজন্য আরডিএ’তে সরকারি- বেসরকারি অর্থাৎ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে দেশি মুরগির হ্যাচারী স্থাপন ও বাণিজ্যিকভাবে বাচ্চা উৎপাদন শুরু করা হয়েছে।