কায়রোতে কড়া নিরাপত্তায় মুরসির দাফন

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ জুন ২০১৯ ০৯:০৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৪৫ বার।

কারাগারে ‘চিকিৎসায় অভাবে’ মৃত্যুর কোলে ঠলে পড়া মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির দাফন সম্পন্ন হয়েছে।মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের কবরের পাশে মিসরের অবিসংবাদী এই নেতাকে দাফন করা হয়। মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ তথ্য জানান, মুরসির ছেলে আহমদ মুরসি। খবর রয়টার্স ও আনাদোলুর।

আহমদ মুরসি জানান, মুরসির নিজ শহর শারকিয়্যায় মুরসির দাফন হোক সেটি চেয়েছিল তার পরিবার। কিন্তু মিসর সরকার সেই আবেদন মঞ্জুর করেনি। তাকে নেসার সিটিতে কড়া নিরাপত্তায় মঙ্গলবার ভোর ৫টায় সমাহিত করা হয়।

সোমবার আদালতেই মৃত্যুর কোলে ঠলে পড়েন মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট। মিসরের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারকের কাছে কথা বলার অনুমতি চাইলে তাকে কথা বলতে অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এ সময় তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। একপর্যায়ে তিনি হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

আলজাজিরার খবরে বলা হয়, রাজধানী কায়রোর আদালতে ফিলিস্তিনি ইসলামিক গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে আঁতাতসংক্রান্ত মামলার শুনানির সময় মুরসি দীর্ঘ সময় বক্তব্য রাখছিলেন। প্রায় ২০ মিনিট বক্তব্য রাখার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় মুরসিকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) দাবি করেছে, কারাগারে সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে মোহাম্মদ মুরসিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে দেশটির সরকার। আন্তর্জাতিক এ মানবাধিকার সংস্থাটি মুসরির মৃত্যুর বিষয়ে নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে জাতিসংঘের কাছে দাবি জানিয়েছে।

সোমবার কারাগারে মৃত্যু হয় মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট মুরসির। এ খবর পাওয়ার পর এক টুইটবার্তায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পরিচালক সারাহ লি উইটসন বলেন, মুরসির মৃত্যুর ঘটনা ভয়ঙ্কর। তবে এটি অনুমেয়। কারণ দেশটির সরকার মুরসিকে সঠিক চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, মিসরের সেনাশাসিত সরকার মুরসিকে বছরের পর বছর বিনা চিকিৎসায় জেলে ভরে রেখেছে। জেলে থাকাবস্থায় তাকে নিয়মিত ওষুধ খেতে দেয়া হয়নি। এমনকি তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি, তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতেও দেয়া হয়নি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই কর্মকর্তা বলেন, মিসরের একনায়ক সরকার মুসরিকে নূনতম বন্দি অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছে।তার প্রতি স্পষ্টত মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছে। আমরা এর নিন্দা জানাই। সেই সঙ্গে মুরসির স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রমাণ দাবি করছি।

মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসেন মুরসি। টানা ১৮ দিনের গণআন্দোলনে মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। মোহাম্মদ মুরসি মুসলিমপন্থী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপরের সারির নেতা ছিলেন। তিনি ২০১২ সালে জনগণের ভোটের মধ্য দিয়ে মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পান। তবে ক্ষমতার এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালে তার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভের সুযোগ নিয়ে মিসরের সেনাবাহিনী মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। পরে প্রেসিডেন্টের মসনদে বসেন মুরসির হাতে সেনাপ্রধান হওয়া আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি।

মিসরের আদালত মুরসিকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। সে সময় মুরসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ভুল তথ্য দিয়েছিলেন। মুরসির বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ ছিল, তিনি অর্থের বিনিময়ে কাতারের কাছে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি পাচার করেছেন। ২০১৪ সালে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছিল। এরপর ২০১৬ সালের জুন মাসে তথ্য পাচারের এ মামলায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন নিম্ন আদালত। আদালত দেশের গুরুত্বপূর্ণ নথি পাচারের অভিযোগে মুরসিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যুর পর দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সমালোচনা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তিনি মুরসিকে শহীদ আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মিসরীয়দের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন মুরসি।

সোমবার রাতে জেলেই মৃত্যু হয় মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসির। এ খবর পাওয়ার পর শোকবার্তা জানান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তিনি বলেন, মিসরীয়দের মুক্তির জন্য শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মুরসি যে সংগ্রাম করে গেছেন, সেটি সব মুসলমান যুগ যুগ স্মরণ করবে।

এরদোগান বলেন, আমাদের কাছে মোহাম্মদ মুরসি শহীদ। ইতিহাস সেই (সিসি) একনায়ককে ক্ষমা করবে না যে কিনা জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে জেল দিয়েছে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নির্যাতন করেছে এবং তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

তিনি বলেন, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি তার হাজার হাজার বিপ্লবী সমর্থককে নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে কারাগারে ছিলেন কিন্তু পাশ্চাত্যের কেউ এর প্রতিবাদ করেনি।

এরদোগান বলেন, আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের শহীদ ভাইদের জন্য দোয়া করছি, আল্লাহ যেন শহীদদের ওপর রহম করেন। আদালতের এজলাসেই তার মৃত্যু হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি আল্লাহর কাছেই রহমত কামনা করি।

ইস্তানবুলের হ্যালিক সেন্টারে দেয়া এক বক্তৃতায় মিসরের শাসকের সমালোচনা করে মুসলিম বিশ্বের এ নেতা বলেন, মিসরের প্রেসিডেন্ট সিসি জনগণের ভোটে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল, গণতন্ত্রকে পদদলিত এবং ক্ষমতায় এসে ৫০ জনকে ফাঁসি দিয়েছেন।

‘মুরসি গণতান্ত্রিক উপায়ে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন; কিন্তু দেশটির সামরিক বাহিনী এ বাস্তবতা মেনে নেয়নি এবং তারা মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার সব ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছিল।’

এরদোগান বলেন, মুরসিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার সব ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। তিনি আদালতে গিয়েও তার ওপর জুলুমের প্রতিবাদ করেছেন। মিসরের জনগণ ও নিজের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিবাদী মুরসির এ মৃত্যু জুলুমের সাক্ষী হয়ে থাকবে।

তিনি বলেন, মিসরের নিপীড়ক শাসক গণতন্ত্র কায়েম করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়া নেতাদের জুলুম করে হয়তো সাময়িক বিজয় অর্জন করেছে। কিন্তু তাদের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস মিসরীয়দের মন থেকে মুছে দিতে পারবে না। তুর্কি প্রেসিডেন্ট ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমালোচনা করে বলেন, সিসি ক্ষমতায় আসার পর মিসরীয়দের ফাঁসি দিলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ বিষয়ে নীরব থেকেছে। এমনকি মিসরে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইউরোপীয় দেশগুলো অংশ নিয়েছে যখন সেখানে ফাঁসির ঘটনা ঘটছিল।

এরদোগান বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্ককে ফাঁসির আদেশ বাতিলের জন্য বারবার আহ্বান জানাচ্ছে কিন্তু মিসরে তারা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এমন সময় অংশ নিয়েছে যখন সে দেশের নাগরিকদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছিল। আর এ থেকে প্রমাণিত হয় ইউরোপ মানবাধিকার বিষয়ে দ্বিমুখী আচরণ করছে।