বগুড়ায় নতুন নেতৃত্বের সন্ধানে আ’লীগ

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০১৯ ১১:৪৬ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৬৮৭ বার।

বগুড়ায় মমতাজ যুগের অবসানের পর জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তার অনুসারীদের হাতে থাকবে না-কি বিরোধীদের কাছে যাবে-এ নিয়ে চলা গুঞ্জনের সম্ভবত ইতি টেনে দিল কেন্দ্র। এ জেলায় দলের পুনর্গঠনে তৃণমুলের নেতারাই যে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবেন সেটি গত ২৪ মে অনুষ্ঠিত যৌথ কর্মী সভায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। 
তৃণমুলের মতামতের ভিত্তিতে দলকে ঢেলে সাজানোর প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে জাহাঙ্গীর কবির নানক ওইদিন বগুড়ার ১০৮টি ইউনিয়ন এবং ১২টি পৌরসভার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে রীতিমত লিখিত পরীক্ষাও নিয়েছেন। পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেও। তাতে নির্ধারিত ফরমে পরীক্ষার্থী তৃণমুলের ওই নেতাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে বাধ্যতামূল মোট ১৩টি করে প্রশ্নের উত্তর লিখে নেওয়া হয়।
তৃণমুলের নেতাদের উদ্দেশ্যে প্রথম প্রশ্নটি ছিল-‘আপনার শাখার সাংগঠনিক অবস্থা কি?’ এরপর অন্যান্য দলের অবস্থার পাশাপাশি ওই ইউনিটে নিজ দলের সর্বশেষ সম্মেলনের তারিখ, সন, পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছিল কি’না? না হলে কেন হয়নি এবং কতদিনের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে, জেলা নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিক সফর করেছেন কি’না, কতবার করেছে, দলের কার্যালয় আছে কি’না, সহযোগী সংগঠনগুলির অবস্থান এবং স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে সমন্বয় রয়েছে কি’না এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়া জাগানো উন্নয়ন, অগ্রগতি ও শান্তির বিষয়গুলি জনগণের মাঝে প্রচারে কি কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী তৃণমুল নেতাদের কাছ থেকে ৫টি বিষয়ে লিখিত মতামত চাওয়া হয়। এগুলো হলো- নারী ও তরুণ নেতৃত্বের বিকাশে করণীয়, কেন মহিলা ভোটে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে থাকে, ধর্ম ব্যবসায়ীদের অপপ্রচার রোধে দলের করণীয়, বিরোধী সংগঠনের আওয়ামী লীগ বিরোধী অপপ্রচার রোধে করণীয় এবং যৌথ কর্মী সভায় অংশগ্রহণের অনুভতির কথাও লিখে জানাতে বলা হয়।
শহরের শহীদ টিটু মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের ওই যৌথ সভার প্রধান অতিথি প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম চলতি বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পূর্বে জেলা সম্মেলনের মাধ্যমে বগুড়ায় দলটির শক্তিশালী কমিটি গঠনেরও ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। আর জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, আগামীতে গঠিত জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই শুধু নয় সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে অন্যান্য পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রত্যেকে যাতে স্ব স্ব অবস্থান থেকে কাজ করতে পারে সেই উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
১৯৯৪ থেকে ২০১৯- দীর্ঘ প্রায় চব্বিশ বছর বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ আঁকড়ে ছিলেন মমতাজ উদ্দিন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর দলের পুনর্গঠন নিয়ে তৃণমুলে নানামুখি আলোচনা শুরু হয়। এমনকি ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের অনেকে চল্লিশ দিন যেতে না যেতেই জেলা আওয়ামী লীগের নতুন সভাপতি কে হচ্ছেন তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে রীতিমত জরিপ শুরু করে দেন।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, একটানা দুই যুগ নেতৃত্ব দিতে গিয়ে মমতাজ উদ্দিন দলের অভ্যন্তরে যেমন শক্তিশালী একটি বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তেমনি সেটি করতে গিয়ে দিনে দিনে তিনি তার বিরোধীদের সংখ্যাও বাড়িয়েছেন। সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম এক দশকে দলের অভ্যন্তরে মমতাজ উদ্দিন প্রকাশ্য বিরোধিতার সম্মুখীন হন। কিন্তু পরবর্তীতে নানাভাবে তিনি তার ব্যক্তি প্রভাব বাড়ালে বিরোধীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এর ফলে সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনের দু’বছরের মাথায় গঠিত ৭১ সদস্য বিশিষ্ট জেলা কমিটিতে মমতাজ উদ্দিনের ৯০ ভাগ অনুসারী জায়গা পেয়ে যান। তবে মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা হতাশায় ডুবেছেন। তাদের অধিকাংশই মমতাজ উদ্দিনের ছোট ছেলে বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান মিলনের কাছে ভিড়েছেন। আগামীতে মিলনকে দলের গুরুত্বপূর্ণ কোন দায়িত্ব দেওয়া হবে-এই আশায় তারা দিন গুণছেন। তবে কেউ কেউ আবার ভবিষ্যত অন্ধকার মনে করে নতুন ‘গুরু’ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন। 
মমতাজ উদ্দিনের বিরোধীদের অভিযোগ, জেলা কমিটিতে নিজের অনুসারীদের অধিকহারে স্থান দিতে গিয়ে অনেক জুনিয়র নেতাকে অতিমূল্যায়ন করা হয়েছে। এতে অনেক সিনিয়র নেতা তার যোগ্যতা অনুযায়ী পদ পাননি। একইভাবে তৃণমুলে দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েও নিজের অনুসারীদেরই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। যার ফলে ত্যাগী নেতারা পিছিয়ে পড়েছেন। অবশ্য মমতাজ উদ্দিন দলের দুই সাংসদ বগুড়া-১  আসনের আব্দুল মান্নান এবং বগুড়া-৫ আসনের হাবিবর রহমানের নির্বাচনী এলাকার ৪ উপজেলায় দলীয় কার্যক্রমে কোন হস্তক্ষেপ করেন নি। অবশ্য জেলা সদরে সংগঠনের কার্যক্রমগুলো ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে শো-ডাউন নির্ভর করে তোলা হয়। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠনটি দিনে দিনে শুধু মিছিল সর্বস্ব হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দিতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা সমকালকে বলেন, এক দশক আগেও বগুড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী কোন দল কোথাও কোন সভা করলে সেখানে ওই দলের বক্তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কি কি বললো  সেটি আমাদের তৃণমুলের নেতাদের অনেকে নোট করে পাল্টা বক্তব্য কি হবে তা জানার জন্য সিনিয়র নেতাদের কাছে আসতেন। তারা এখনও আছে। কিন্তু এখন তাদেরকে শুধু নির্দিষ্ট দিনে মিছিলের শ্লোগান দেওয়া ছাড়া সেভাবে সংগঠনকে সময় দিতে দেখা যায় না।
তবে প্রয়াত সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের অনুসারীদের দাবি ছাত্রলীগ থেকে যুবলীগ তার পর আওয়ামী লীগ- এভাবেই তিনি দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে বগুড়ায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকা বহন করেছেন। এছাড়া প্রায় ২৪ বছর জেলা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে তিনি দলটির সাংগঠনিক কাঠামো আগের যে কোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়েছেন। যার ফলস্বরূপ পঁচাত্তরের পরবর্তী দুঃসহ অবস্থা থেকে দল ঘুড়ে দাঁড়িয়েছে এবং ২০০৮ সাল থেকে জাতীয় সংসদে নৌকার প্রার্থীরা আবার বিজয়ী হতে শুরু করেছে। উপজেলা এবং পৌরসভাতেও নৌকার প্রার্থীদের সফলতা আসতে শুরু করেছে। তিনি কখনো দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাননি। যার প্রমাণ সর্বশেষ জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান হওয়ার স্বপ্নটি শুধুমাত্র দলীয় মনোনয়নের অভাবে পূরণ না হওয়ার বেদনা সত্ত্বেও মমতাজ উদ্দিন দলের প্রতি  প্রতি সীমাহীন আনুগত্য দেখিয়েছেন। মমতাজ উদ্দিনের অনুসারীদের মতে নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তিনি যে সফলতা দেখিয়েছেন আগামীতে এই জেলায় তা কারো পক্ষে করে দেখানো রীতিমত চ্যালেঞ্জ হবে।
বগুড়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দল পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেশ কয়েকজন নেতার নাম আলোচনায় রয়েছে। তারা হলেন- বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. মকবুল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান মজনু, দুই সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম মন্টু ও অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন মুকুল এবং তিন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে রাগেবুল আহসান রিপু, টি. জামান নিকেতা ও মঞ্জুরুল আলম মোহন। এর বাইরে আরোও একজনের নাম আলোচনায় রয়েছে। তিনি হলেন জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের ছোট ছেলে ব্যবসায়ী মাসুদুর রহমান মিলন। মমতাজ উদ্দিনের অনুসারীরা তাকে সাধারণ সম্পাদক পদে দেখতে চান। ওই অংশটি এর আগে বগুড়া-৬ (সদর) আসনে উপ-নির্বাচনেও তাকে দলীয় প্রার্থী করার দাবি তুলেছিল। কিন্তু হাইকমান্ড তা আমলে নেননি।
দলীয় সূত্র জানায়, পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে দলের ভেতরে দুই ধরনর আলোচনা রয়েছে। একটি অংশ বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সভাপতিকে ভারমুক্ত করা এবং সাধারণ সম্পাদককে স্বপদে বহাল রাখার পক্ষে। অন্য একটি অংশ দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান মজনুকে সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নতুন কাউকে খুঁজে নেওয়ার পক্ষপাতি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধিকাংশই মজিবর রহমান মজনুকে সভাপতি পদে দেখতে আগ্রহী।
আওয়ামী লীগ বগুড়া শহর কমিটির আহবায়ক রফি নেওয়াজ খান রবিন বলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা এসেছিলেন তারা দলের পুনর্গঠনসহ নেতৃত্বকে গতিশীল করার জন্যই তৃণমুলের মতামত নিয়ে গেছেন। তৃণমুলের সিদ্ধান্তেই আগামী দিনে দল পরিচালিত হবে। একই সংগঠনের যুগ্ম আহবায়ক শেখ শামিম বলেন, পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা হলো এমন নেতৃত্বকে বাছাই করতে হবে যারা দলটিকে বঙ্গন্ধুর আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত করবে। তবে জেলা আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক মাশরাফি হিরো মনে করেন প্রয়াত সভাপতি মমতাজ উদ্দিন দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে দলকে অনেক শ্রম দিয়েছেন। তাঁর ছেলেকে যদি মূল্যায়ন করা যেতে পারে।
তবে দলের জেলা কমিটির দুই সিনিয়র নেতার একজন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু বলেন, আমরা দলে কোন দুর্বৃত্তায়ন দেখতে চাই না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা যে দৃঢ়তা দেখিয়ে যাচ্ছেন তাতে আমরা আশাবাদী। দলের জেলা কমিটির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মজিবর রহমান মজনু বলেন, দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদকের পালন করেছি। এখন যদি নেতা-কর্মীরা আমাকে সভাপতির দায়িত্ব দিতে চান তাহলে আমি তা নিতে প্রস্তুত আছি এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে দলকে আরও সুসংগঠিত করার চেষ্টা করে যাব।