বৈশাখী মেলা বগুড়ার ঐতিহ্যের সঙ্গেই মিশে গেছে

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট:
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০১৮ ১৪:৪৮ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৫০ বার।

[বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে বাংলাদেশের অনেক স্থানেই বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। তবে উত্তরাঞ্চলের প্রাণ কেন্দ্র বগুড়া শহরের বৈশাখী মেলাটি বেশ পুরানো। গেল শতাব্দীর ষাটের দশকে প্রথম এ মেলার আয়োজন করা হয়। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নানা কারণে সেই মেলা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৮০ সালে বগুড়া থিয়েটার গঠিত হওয়ার পর থেকে আবারও নতুন করে বৈশাখী মেলা আয়োজন করা হয়। তিন যুগে মেলার স্থান বদলেছে বেড়েছে আয়োজন এবং আয়তনও। আজ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে ঐতিহ্যবাহী বগুড়ার সেই মেলার ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছে পুণ্ড্রকথা]


বগুড়ায় বৈশাখী মেলার শুরুটা হয়েছিল মাত্র তিনটি দোকান নিয়ে। যার দু’টিই ছিল আয়োজক সংগঠন বগুড়া থিয়েটারের দুই কর্মীর। তবে তিন যুগের ব্যবধানে সেই মেলার আয়োজন এবং আয়তন এতটাই বেড়েছে যে এখন ¯্রােতের মত আসা মানুষের ভিড়ে শহরের প্রধান সড়কগুলোই যেন হারিয়ে যায়। শুরুর দিকে মেলা হতো তিন দিন আর এখন চলে পাঁচদিন।
পালা গান, পুতুল নাচ, লাঠি খেলা, মোরগ লড়াই, পাতা ও সাপ খেলার মত গ্রামীণ লোক সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ এ মেলাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। যেটি অন্য কোথাও তেমন আর চোখে পড়ে না। তাইতো বাঙালি ঐতিহ্যের স্বরূপগুলো দেখতে কর্মব্যস্ত শহুরে মানুষগুলো তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ছুটে যান বৈশাখী মেলায়। বাঙালিয়ানার স্বাদ নিতে ধর্মীয় পরিচয় ভুলে তারা মেতে উঠেন সার্বজীনন এক উৎসবে।
চিরায়ত সাংস্কৃতিক উৎসবের রঙ সব ধর্মের মানুষকে ভেতর থেকে রাঙিয়ে দেয় বলেই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের দিন পহেলা বৈশাখ এখন অসম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। আর সে কারণে বছরের প্রথম এই দিনটিতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরবাসী ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে বেড়িয়ে পড়েন মেলার উদ্দেশ্যে। এক্ষেত্রে ধর্মীয় উৎসবগুলোর মত বৈশাখেও নতুন কাপড় গায়ে জড়ানো যেন এক রীতিতে পরিণত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জঙ্গী তৎপরতার প্রেক্ষিতে প্রশাসনের নির্দেশে আয়োজনে কিছু কাটছাঁট বিশেষত সন্ধ্যার পর মেলা বন্ধ রাখা হলেও উৎসব পাগল মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়নি।

বগুড়া থিয়েটারের পক্ষ থেকে এ জেলায় বৈশাখী মেলার প্রথম আয়োজন করা হয় ১৩৮৮ বঙ্গাব্দে (১৯৮১ খ্রীস্টাব্দ)। আয়োজকদের একজন তৌফিক হাসান ময়না জানান, ১৯৮০ সালে বগুড়া থিয়েটার গঠিত হওয়ার পরের বছরই তারা মেলার গোড়া পত্তন করেন। বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে মেলা আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, এটি গ্রাম থিয়েটারের একটি দর্শন বলা যেতে পারে। এর উদ্যোক্তা ছিলেন প্রয়াত নাট্যগুরু ড. সেলিম আল দীন। বাঙালির যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা তা গ্রামীণ লোক সংস্কৃতি লালনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি বৈশাখী মেলার গোড়া পত্তন করতে বলেছিলেন। একই সঙ্গে যেসব ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে সেগুলোকেও মেলা আয়োজনের মাধ্যমে রক্ষা করা সম্ভব বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন। তার মতে বাঙালির যে সংস্কৃতি সেটি চর্চার মাধ্যমেই সব ধর্ম মতকে এক সুতোয় গাঁথা সম্ভব। তৌফিক হাসান ময়না বলেন, ‘মূলত ড. সেলিম আল দীনের আহবানে সাড়া দিয়েই আমরা ৩৭ বছর আগে বগুড়ায় বৈশাখী মেলা শুরু করি।’

বগুড়া শহরের চেলোপাড়ায় করতোয়া নদী তীরে (বর্তমানে চাষী বাজার) ৩টি দোকান নিয়ে প্রথম বৈশাখী মেলার উদ্বোধন করেছিলেন বগুড়ার প্রয়াত কবি রুস্তম আলী কর্ণপুরী। একেবারেই ছোট্ট পরিসরের সেই মেলার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বগুড়া থিয়েটারের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না জানান, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে শহরে যে একটা মেলার আয়োজন হতে পারে তখন সেটি অনেকেরই ধারণার বাইরে ছিল। তিনি বলেন, ‘প্রথম ওই মেলায় ৩টি দোকান বসাতে পেরেছিলাম। এর মধ্যে বই আর খেলনা সামগ্রীর দু’টি দোকান দিয়েছিলেন আমাদের দুই কর্মী আর স্থানীয় এক ব্যক্তি বসেছিলেন পানের দেকান নিয়ে। তিন দিনের ওই মেলায় আমরা থিয়েটারের কর্মীরা প্রতিদিনই পালাগান করতাম। তা দেখতে মানুষ ভিড় করতেন। সে সময় বগুড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক নিমাই ভট্টাচার্য দ্বিতীয় দিন আমাদের মেলা দেখতে এসেছিলেন।’

পর পর দু’বার করতোয়া নদী তীরে আয়োজনের পর মেলাটিকে শহরের সুত্রাপুরে শহীদ টিটু মিলনায়তন চত্বরে নেওয়া হয়। তারও দু’ বছর পর মেলাটিকে পাশের পৌর পার্কে স্থানান্তর করা হয়। তখনই মেলার আয়োজন বাড়িয়ে পাঁচদিন করা হয়। পার্কের ভেতরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন মঞ্চকে মাঝে রেখে তার তিন দিকে মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল এবং খেলনা সামগ্রীর দোকান বসানো হতো। তবে ২০০৫ সালে পার্কের ভেতরের অবকাঠামো উন্নয়নের পৌর কর্তৃপক্ষ সেখানে দোকান বসানোয় আপত্তি করেন। তখন থেকে মেলার দোকানগুলো পার্কের দক্ষিণ অংশে শহীদ টিটু মিলনায়তন চত্বরে নেওয়া হয়। তবে পার্কের ভেতরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন মঞ্চে মেলা উপলক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খোলা জায়গায় মোরগ লড়াই, লাঠি খেলা, সাপ খেলা, পাতা খেলা এবং উডবার্ণ মিলনায়তনে পুতুল নাচের আয়োজন আগের মতই অব্যাহত রয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মেলায় লোক সমাগম বেড়ে যাওয়ায় দোকানের সংখ্যাও বেড়েছে। হরেক রকম পণ্যে ঠাসা দোকানগুলো এখন মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সড়কের দুই পাশের জায়গা দখল করে নেয়। ভেতরে-বাইরে সব মিলিয়ে অন্তত দেড় শতাধিক দোকানে টানা পাঁচদিন বেচা-কেনা চলে। আর বৈশাখ উপলক্ষ্যে শহরের বিপনী বিতানগুলোতে তো চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। ছেলেদের ফতুয়া, পাজামা-পাঞ্জাবী আর মেয়েদের শাড়ি বরাবরই বিক্রির শীর্ষে থাকে। এছাড়া ফুল, মিষ্টি এবং দইয়ের বেচা-কেনাও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। বৈশাখী মেলার আয়োকজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেলার প্রথম আর শেষ দিন সবচেয়ে বেশি বেচা-কেনা হয়। পাঁচদিনে কম করে হলেও ২০ লাখ টাকার পণ্য বেচা-কেনা হয়। অন্যদিকে বিপনী বিতান মালিকদের হিসাব অনুুযায়ী বাংলা নববর্ষ উদযাপনের দিনটিকে ঘিরে প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।

বিশিষ্ট লেখক বজলুল করিম বাহার মনে করেন বৈশাখী মেলা আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিরই অংশ। তিনি জানান, অনেক আগে বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে বৈশাখী মেলা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হালখাতা হতো। কিন্তু নানা কারণে সেগুলো হারিয়ে গেছে। অবশ্য ষাটের দশকে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে বগুড়া শহরের জিরো পয়েন্ট সাতমাথায় গণসঙ্গীতের আয়োজন করা হতো। আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে হতো লাঠি খেলা। বগুড়া থিয়েটারের বৈশাখী মেলা আয়োজনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করছে-এটা অবশ্যই ভাল একটা উদ্যোগ। আমি মনে করি বাংলা নববর্ষকে আরও ভালভাবে পালন করা উচিত। ঈদের দিন যদি আমরা নতুন কাপড় পড়তে পরি। ভাল খেতে পারি। তাহলে বছরের প্রথম দিন হিসেবে পহেলা বৈশাখেও কেন আমরা তা করতে পারবো না?’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বগুড়া জিলা স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক জেলার আগেই বগুড়ায় থিয়েটারের আয়োজনে বৈশাখী মেলা শুরু হয়েছে। এটি এমন একটি উৎসব যাতে সব ধর্মের মানুষ একাকার হয়ে যায়। বৈশাখ এলে আমাদের বয়সী মানুষগুলো তো বটেই তরুণ প্রজন্মও অনেক আনন্দ পায়।’ বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান জানান, অসম্প্রদায়িক চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম উপলক্ষ্য হলো বৈশাখী মেলা। এজন্য জঙ্গীরা বার বার এ মেলাকে টার্গেট করতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের কাছে কখনও নতি স্বীকার করিনি, ভবিষ্যতেও করবো না।