আমাদের মা জননী-২৩

ক্ষমা যখন সব কিছুকেই হারিয়ে দেয়

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০১৯ ১৪:০৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩৪২ বার।

[গতকালের পর থেকে পড়তে হবে] 
হযরত আয়েশা রা:-এর প্রতি অপবাদ ঘটনার ব্যাপারে একসময় আল্লাহ তায়ালা প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করে দিলেন এবং উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা রা:-এর নির্দোষিতা প্রমাণিত হলো, আর মুসলিমদের অন্তর উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, যে সমস্ত মুলমানরা ভুল করেছিলেন তাদের তাওবা কবুল করা হলো এবং অপবাদ রটানোর কাজে সহযোগী হওয়ার কারণে তিনজনকে শাস্তিও দেয়া হলো। এই তিনজনের মধ্যে একজন ছিলেন হযরত মিসতাহ ইবনে উসাসা রা:। তিনি হযরত আবু বক্কর রা: এর স্ত্রী সম্পর্কিত ভাগ্নে ছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই দরিদ্র লোক। হযরত আবু বক্কর রা: তাঁকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে লালন পালন করে আসছিলেন। তিনি ছিলেন মুহাজির (দেশত্যাগী, অর্থাৎ মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এসেছিলেন) এবং বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে ভুলবশত: হযরত আয়েশা রা:-এর প্রতি অপবাদ রটানোর ঘটনায় তাঁর মুখ খুলে গিয়েছিলো। এই অপরাধে তিনি ৮০টি বেত্রাঘাতের দণ্ডও ভোগ করেছিলেন। তাঁর এই আচরণে হযরত আবু বক্কর রা: স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হলেন, কারণ হযরত আবু বকর রা: তাঁর প্রিয় কন্যার কষ্ট পাওয়ার কথা সহজে ভোলার মতোও নয়। তাই কন্যা আয়েশা রা: আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার পর হযরত আবু বকর রা: কসম খেয়ে বললেন যে, তিনি ভবিষ্যতে মিসতাহ ইবনে উসাসা রা: কে আর কোনো আর্থিক সাহায্য করবেন না। হযরত আবু বকর রা: এর এই প্রতিজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা বলেন ঃ 
“তোমাদের মধ্যে যারা উচ্চ মর্যাদা ও পার্থিব প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন কসম না খায় যে, তারা আত্মীয় স্বজনকে, অভাব গ্রস্তকে ও আল্লাহর পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না। তাদেরকে ক্ষমা করা উচিত এবং দোষ ত্র“টি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি কামনা কর না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন ? আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়। সূরা আন নূরঃ ২২।
ওপরের ঐ আয়াতটি হযরত আবু বকর রা:-এর ব্যাপারে নাযিল হয়। এই আয়াতের শেষ কথা বলা হয়েছে যে, তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের গুনাহ মাফ করেন ? আয়াতটি শুনে হযরত আবু বকর রা: তাৎক্ষনাৎ বলে উঠেন ঃ “আল্লাহর কসম! আল্লাহ আমাকে মাফ করুন, আমি অবশ্যই গুনাহ মাফ করাকে পছন্দ করি।” এরপর তিনি হযরত মিসতাহ রা: এর প্রতি আর্থিক সাহায্য পুনর্বহাল করে দেন এবং বলেনঃ এ সাহায্য কোনো দিন বন্ধ হবে না।১ শুধু তাই নয়, হযরত আবু বকর রা: বরং আগের চেয়ে বেশি সাহায্য মিসতাহ রা: কে দিতে থাকলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বর্ণনা করেছেনঃ এরূপ কসম হযরত আবু বকর রা: ছাড়া অন্য কয়েকজন সাহাবিও করেছিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, যে সব লোক এ মিথ্যা দোষারোপে অংশগ্রহণ করেছে, তাঁরা তাদেরকে আর সাহায্য সহযোগিতা করবে না। এই আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর তাঁরা প্রত্যেকেই সে মনোভাব ত্যাগ করেন। ফলে অপবাদ ঘটনার কারণে মুসলিম সমাজে জমে ওঠা তিক্ততা সঙ্গে সঙ্গেই দূর হয়ে যা।
হযরত আয়েশা রাঃ-ও অপবাদ রটনা কাজে অংশ নেয়া মুসলমানদের ক্ষমা করেছিলেন। হযরত আয়েশা রা: তাদের প্রতি ভীষণ রকমের শালীনতা ও সৌজন্যবোধ দেখাতেন। তাঁর সদ্ব্যবহারের নমুনা ছিল এমন যে, “মুসলমানদের প্রখ্যাত কবি হযরত হাসসান ইবনে সাবেত রা: হযরত আয়েশা রা: এর বদনাম করার জন্যে খুব বেশি কাজ করেছিলেন। কিন্তু তা স্বত্বেও আয়েশা রা: পরবর্তীতে তাঁর সঙ্গে সব সময় ভালো ব্যবহার করেছেন। এর দরুণ লোকেরা আয়েশা রা: কে স্মরণ করে দিয়ে বলতো, “এই ব্যক্তিই (কবি হাসসান) তো আপনার বদনাম করছিলো।” তখন হযরত আয়েশা রা: লোকজনকে জবাব দিয়েছিলেন যে, এ সেই ব্যক্তি (কবি হাসসান) যিনি ইসলামের দুশমন কবিদের জবাব দিয়েছিলেন রাসূল সা: এর পক্ষ থেকে।” এই কথা বলে হযরত আয়েশা রা: লোকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার দ্বারা হযরত আয়েশা রা: এর ক্ষমা গুণের অন্যন্য পরিচয় পাওয়া যায়। ক্ষমা প্রদর্শন করেই তিনি যেন সবকিছুকে হারিয়ে দিলেন।
মর্যাদাবান ও ধনবান লোকদের অধিক সহনশীল হতে হবে ঃ
হযরত আয়েশা রা:-এর প্রতি অপবাদ প্রচার কাজে ভুলবশত: অংশগ্রহণ করার কারণে হযরত আবু বকর রা: তাঁর নিকট আত্মীয় অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল হযরত মিসতাহ রা:-কে আর আর্থিক সাহায্য করবেন না বলে কসম (শপথ) খেয়েছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সূরা নূরের ২২নং আয়াত নাযিল করেন। এই আয়াতের একটি বিরাট শিক্ষা হলো এই যে, যারা মর্যাদাবান ও ধনবান তারা যেনো এরূপ শপথ না করেন যে, তারা তাদের আত্মীয় স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও দেশত্যাগী মুহাজিরদেরকে তাদের কোনো ভূল ত্র“টির কারণে আর কিছুই দিবে না। এ ধরণের অসহায় লোকদের প্রতি মর্যাদাবান ও ধনবান ব্যক্তিদের সবসময় যেন সদয় দৃষ্টি থাকে, এই জন্যে মর্যাদাবান ও ধনবান ব্যক্তিদের মনকে নরম করার জন্যে আল্লাহ বলছেন যে, “তারা যদি কোনো ত্র“টি বিচ্যুতি করে বসে, তাহলে তাদের দোষত্র“টি উপেক্ষা করে যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়।” অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সূনা আন নূরের ২২নং আয়াতের মাধ্যমে গোটা মানব জাতিকে এই শিক্ষাই দিচ্ছেন যে, “যারা অনুগ্রহশীল ও সামর্থ্যবান, তারা যেন কসম খেয়ে না বসে যে, তারা নিজেদের আত্মীয় স্বজন, গরীব-মিসকিন ও আল্লাহর পথের মুহাজির লোকদের সাহায্য করবে না। তাদেরকে তো ক্ষমা ও মার্জনা করা উচিত। তোমরা কি চাওনা যে, আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিবেন? আর আল্লাহর পরিচয় এই যে, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।”
[তথ্য সূত্র: ১.বুখারি, মুসলিম; উদ্ধৃতঃ মা’ আরেফুল কোরআন, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৭৭।]

 [পরবর্তী অংশ আগামীকাল]