কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আমানত ফেরত দিতে পারছে না

১২ আর্থিক প্রতিষ্ঠান লাল তালিকায়

পুন্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০১৯ ০৩:২৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪১৫ বার।

অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে চরম সংকটে পড়া পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই কারণে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) অবসায়ন চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে মন্ত্রণালয়ের মতামত এখনও পাওয়া যায়নি। ব্যাংকবহির্ভূত এই দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের উন্নতি করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। লিজিং কোম্পানি নামে পরিচিত আরও নয়টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ রয়েছে দুই অঙ্কের ঘরে। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রে আমানতকারীর জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। নাজুক অবস্থায় থাকা এমন ১২ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রেড জোন বা লাল তালিকাভুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। খবর সমকাল অনলাইন

সংশ্নিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিয়ে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। খেলাপি ঋণ, প্রভিশন সংরক্ষণ, মূলধন পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন সক্ষমতা বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাল, হলুদ ও সবুজ তালিকাভুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে হলুদ তালিকায় রয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সবুজ বা সবচেয়ে ভালো তালিকায়। লাল তালিকা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো। 

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, পিপলস লিজিংসহ আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ব্যক্তি পর্যায়ে বড় অঙ্কের আমানত এবং প্রাতিষ্ঠানিক আমানত ফেরত দিতে পারছে না। বিআইএফসি, ফার্স্ট ফাইন্যান্স ও এফএএস ফাইন্যান্সের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে অনেক অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নতুন আমানত না পাওয়ায় এর কোনো সুরাহা করতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান কিছু ব্যাংকের চেয়েও সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে।

একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি বর্তমানের এ সংকটের কথা স্বীকার করে সমকালকে বলেন, ব্যাংকগুলো গ্রাহকের কাছ থেকে চলতি, সঞ্চয়ী, মেয়াদিসহ সব ধরনের আমানত নিতে পারে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তিন মাসের কম মেয়াদে কোনো আমানত নিতে পারে না। পরিচিতি কম থাকায় উচ্চ সুদ দিয়েও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত পেতে হিমশিম খেতে হয়। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আমানতের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয়। যার বড় অংশ আসে ব্যাংক থেকে। তবে এখন ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের কারণে নতুন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে চাচ্ছে না। এর প্রভাবে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান আগের নেওয়া আমানতও ফেরত দিতে পারছে না।

রেড জোনে থাকা ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানতে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. শাহ আলম ১০ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তারল্যের ওপর চাপ থাকায় সাময়িক সমস্যা হতে পারে। তবে সব আমানতকারীর অর্থ ফেরতের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। গ্রাহকদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিআইএফসি, পিপলস লিজিং ও ফার্স্ট ফাইন্যান্সের। বিআইএফসির মোট ঋণের ৯৬ শতাংশ খেলাপি। কোনো পরিচালন আয় না থাকায় প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে ৬ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির। কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিআইএফসিতে রয়েছে মাত্র ২৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ রয়েছে অবসায়নের উদ্যোগ নেওয়া পিপলস লিজিংয়ের। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয় ৫০ কোটি টাকা। আর ফার্স্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। প্রয়োজনের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির মূলধন কম রয়েছে ২০ কোটি টাকা। এ প্রতিষ্ঠানও এতটাই সংকটে পড়েছে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) মতো টাকা নেই। যে কারণে গত বছর এক কোটি টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। ফার্স্ট ফাইন্যান্সের অডিটর গতকাল মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮ সালের অডিট রিপোর্টের ওপর বিশেষ পর্যবেক্ষণ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ৪৬ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে, যা পূরণের সক্ষমতা না থাকায় বিশেষ বিবেচনায় পাঁচ বছর সময় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

প্রিমিয়ার লিজিং নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের ২৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর মূলধন ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ হিসাব বছরে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ায় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানটি 'এ' ক্যাটাগরি থেকে 'বি' ক্যাটাগরিতে নেমে গেছে। পর্যায়ক্রমে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের মোট ঋণের ২৪ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি। সরকারি মালিকানার ইডকলের খেলাপি ঋণ ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। গত বছর সাড়ে ১৬ কোটি টাকা লোকসান করা প্রাইম ফাইন্যান্সের ঋণের ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ খেলাপি। ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া এফএএস ফাইন্যান্সের ১৫ দশমিক ৪১ শতাংশ, মাইডাস ফাইন্যান্সিংয়ের ১৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ, জিএসপি ফাইন্যান্সের ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ১০ দশমিক ২৬ শতাংশ ঋণ খেলাপি।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা বিআইএফসি থেকে নামে-বেনামে নেওয়া বিপুল অঙ্কের ঋণে অনিয়ম হয়েছে এবং বড় অঙ্কের অর্থ খেলাপি হয়ে গেছে। আর কোনো বিকল্প না থাকায় বিআইএফসির অবসায়ন চেয়ে গত বছরের শুরুর দিকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের কাছে চিঠি লেখেন গভর্নর ফজলে কবির। 

জানতে চাইলে বিআইএফসির ভারপ্রাপ্ত এমডি এমএম মোস্তফা বিলাল সমকালকে বলেন, ঋণের বেশিরভাগই খেলাপি হওয়ায় আমানতকারীদের অর্থ ফেরত এবং সময়মতো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে সমস্যা হচ্ছে। আপাতত প্রাতিষ্ঠানিক কোনো আমানত ফেরত দিতে পারছেন না। যখনই কিছু টাকা আদায় হচ্ছে, তখন তা ক্ষুদ্র আমানতকারীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। একটি তালিকা করে পর্যায়ক্রমে ৫০ হাজার টাকা করে ফেরত দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে উঠে আসে, পিপলস লিজিং থেকে বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক পরিচালকরা তুলে নিয়েছেন। ভুয়া কাগজ তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ২০১৫ সালে ৫ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেশ কিছুদিন ধরে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ জুন অবসায়ক নিয়োগ করেছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে খারাপ পর্যায়ে আনার পেছনে অভিযুক্ত সাবেক আট পরিচালক ও তিন কর্মকর্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ এবং সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে আমানতকারীদের জমানো ২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা কোন উপায়ে ফেরত দেওয়া যায় তা নিয়ে কাজ চলছে।