গাইবান্ধায় বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ জুলাই ২০১৯ ০৮:২৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৫৩ বার।

এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান বন্যা গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়ী ও সাদুল্লাপুর উপজেলায় ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ছয় লক্ষাধিক মানুষ। বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। অনেক এলাকায় ডুবে গেছে চরাঞ্চল ও মূল-ভূখণ্ডের সম্পূর্ণ ঘর।

বন্যাকবলিত এসব উপজেলায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও রাস্তায়। খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। ১৯৮৮ সালের বন্যার চেয়ে দেড় ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবারের বন্যায়। ফলে দিন দিন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাচ্ছে।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিপদসীমার উপরে রয়েছে গাইবান্ধার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদ ও শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘাঘট নদীর পানি।

এ জেলায় সবচেয়ে বড় বন্যাগুলোর মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ফুলছড়িঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও এবারের বন্যায় প্রবাহিত হয়েছে বিপদসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

এ ছাড়া গোবিন্দগঞ্জে করতোয়া নদীর পানি বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বাড়ছে নদীর পানি।

 

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ৫৮৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে ছয় লাখ ৫০ হাজার টাকা। ১১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ২৭ হাজার ৩৩০ জন। ভেসে গেছে এক হাজার ৯৫৫টি পুকুরের মাছ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৫ হাজার ৯৩০টি ঘর-বাড়ি। নিমজ্জিত রয়েছে ছয় হাজার ২৭৬ হেক্টর জমির ফসল। ২০৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৩০টি মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা বন্ধ রয়েছে জেলার সাত উপজেলায়।

এ ছাড়া ভাঙনের কবলে পড়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের মধ্য কাতলামারী, কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের কেতকিরহাট, কাইয়ারহাট ও ভাষারপাড়া, সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের মধ্য বাগুড়িয়া, ঘাঘট নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে সদরের খোলাহাটী ইউনিয়নের ফারাজিপাড়া ও পূর্বকুঠিপাড়া, বল্লমঝাড় ইউনিয়নের কাজলঢোপ এলাকায় বাঁধ ভেঙে অনবরত লোকালয়ে প্রবেশ করছে পানি। ফলে বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

গাইবান্ধা শহরের পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আলাই নদীর ডান পাশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ না থাকায় প্লাবিত হয়েছে জেলা শহর।

গাইবান্ধা পৌর এলাকার কুঠিপাড়া, পূর্বপাড়া, মুন্সিপাড়া, বানিয়ারজান, উত্তর বানিয়ারজান, দক্ষিণ বানিয়ারজান এলাকা দিয়ে পানি প্রবেশ করেছে শহরের বিভিন্ন এলাকাগুলোয়।

জেলার প্রধান কাঁচাবাজরের আড়ৎ পুরাতন বাজারে পানি প্রবেশ করেছে। পানি প্রবেশ করেছে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও জেলা জজের বাসভবনেও। পানি ঢুকেছে বাংলা বাজারের সদর উপজেলা পরিষদেও। ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়ে পড়েছে কাচারিবাজার, মাষ্টারপাড়া, কলেজপাড়া, প্রফেসর কলোনি, গোরস্থানপাড়া, আদর্শপাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকা।

শহরে পানি চলে এসেছে শনিমন্দির রোডের কাছে। প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কার্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বন্যার পানির কারণে বন্ধ রয়েছে অনেক দোকান। বন্যার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিন হাজিরারভিত্তিতে কাজ করা দিনমজুররা পড়েছেন বিপাকে।

এই বন্যার মধ্যেও পরীক্ষা চলমান থাকায় বিপাকে পড়েছে গাইবান্ধা কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এক বুক পানি ডিঙিয়ে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে তাদের। ফলে চরম কষ্টের মধ্যে পরীক্ষার সেন্টারে গিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে তারা।

কাঁচা ও পাকা রাস্তা তলিয়ে গেছে কয়েকশ কিলোমিটার। প্রবল পানির স্রোতে কালভার্ট ধসে গেছে ছয়টি। বল্লমঝাড়ের কাজলঢোপে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পানির চাপে হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা।

ইতোমধ্যে সাঘাটার ভরতখালী ইউনিয়নের পোড়াগ্রামে রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে সাঘাটা উপজেলার সাথে। পানির স্রোতে তলিয়ে গেছে গাইবান্ধা-লক্ষ্নীপুর-সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা-বালাসীঘাট, গাইবান্ধা-সাদুল্লাপুর, গাইবান্ধা-ফুলছড়ি সড়ক।

বন্যার পানির স্রোতের ত্রিমোহিনী-বাদিয়াখালী রেলপথের লাইনের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় ভেসে রয়েছে রেললাইন। বন্ধ রয়েছে ট্রেন চলাচল। ফলে সাঘাটার বোনারপাড়া থেকে ট্রেন চলবে বগুড়ার শান্তাহার ও গাইবান্ধা স্টেশন থেকে ট্রেন চলবে রংপুর-দিনাজপুরের উপর দিয়ে পঞ্চগড় ও লালমনিরহাটের বুড়িমারী পর্যন্ত। আর রংপুর ও লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেন চলবে রংপুরের উপর দিয়ে দিনাজপুরের পার্বতীপুর জংশন হয়ে ঢাকায়।

বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করায় জেলার সাত উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হওয়ায় ডুবে গেছে ফসলের ক্ষেত। ফলে এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে দাম বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম।

বন্যা কবলিত এলাকায় চাহিদার তুলনায় ত্রাণ খুবই কম পরিমাণে বিতরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বন্যার্তরা। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের উজান বোচাগাড়ী গ্রামের বাবলু মিয়া বলেন, “১০ দিন থেকে বন্যার কবলে পড়েছে আমাদের গ্রাম। এখন পর্যন্ত কোন সাহায্য সহযোগিতা পাইনি আমরা। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে গ্রামের মানুষদের।”

ফুলড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের কঞ্চিপাড়া গ্রামের রবিউল ইসলাম বলেন, ঘরে এক বুক পানি। টিউবওয়েল ডুবে গেছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দরকার। রান্নার উপকরণ ভিজে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। রাস্তায় ১৫ থেকে ২০ ফুটের উপরে পানি।

সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নবীনেওয়াজ বলেন, সাদুল্লাপুরে হুমকির মুখে রয়েছে ঘাঘট নদীর কামারপাড়া ইউনিয়নের পুরান লক্ষীপুর এলাকা ও বনগ্রাম ইউনিয়নের মনদুয়ারে ব্রীজের কাছের বাঁধ। বাঁধ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।

গাইবান্ধা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, “গাইবান্ধায় এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা হয়েছে গাইবান্ধায়। পূর্বকুঠিপাড়ায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে ও  আলাইয়ের (ডান পাশে) পশ্চিমে বাঁধ না থাকায় শহরে পানি প্রবেশ করেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি। আমরা চিন্তা করছি, কিভাবে করা হয়।

জেলা প্রশাসক রোখছানা বেগম (ভারপ্রাপ্ত) বলেন, “বন্যাকবলিতদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোথাও খাদ্য সংকট হলে সাথে সাথে আমাদেরকে অবহিত করুন। প্রত্যেক পরিবারকে মানবিক সহায়তা দেওয়া হবে।

এ ছাড়া যেকোন প্রয়োজনে ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান, ইউএনওসহ এডিসি (সার্বিক) ০১৭৬২-৬৯৫০৫১, এডিসি (রাজস্ব) ০১৭৬২-৬৯৫০৫২ এবং এনডিসিকে ০১৭৬২-৬৯৫০৫৫ জানালে আমরা চেষ্টা করবো পৌঁছে দেওয়ার জন্য।