অনেকে বাধ্য হয়েই বেচে দিচ্ছেন

বন্যা: বগুড়ার তিন উপজেলায় গো খাদ্যের সংকট, কৃষক ও খামারিরা দিশেহারা

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০১৯ ০৯:৫১ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩৯৩ বার।

বন্যার কারণে গবাদি পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বগুড়ার তিন উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। গো খাদ্যের চরম সংকটের কারণে একদিকে তারা যেমন গরু-ছাগলগুলোকে নিয়মিত খাবার দিতে পারছেন না তেমনি শুকনা জায়গার অভাবে গৃহ পালিত পশুগুলোকে নিরাপদ স্থানে রাখার জায়গাও খুজে পাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে যারা কোরবাণীর ঈদের জন্য গরু-ছাগল লালন-পালন করে আসছেন তাদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। 
কেননা, কোরবাণীর ঈদের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। কিন্তু নিয়মিত খাবার দিতে না পারায় এরই মধ্যে গরু-ছাগলগুলোর ওজন কমতে শুরু করেছে। এতে সেগুলোকে হাটে তুলে ভাল দাম না পাওয়ার আশঙ্কাও প্রবল হয়েছে। তবে গরু-ছাগলগুলোকে যে আগামী বছরের কোরবাণী ঈদের জন্য রেখে দিবেন-সেই পরিস্থিতিও নেই। কারণ যমুনা এবং বাঙালির প্রতি মুহুর্তে যেভাবে বাড়ছে তাতে গবাদি পশু রাখার জন্য শুকনো জায়গার পরিমাণও দ্রুত কমে আসছে।
বন্যায় প্লাবিত এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, গবাদি পশু বিশেষ করে কোরবাণীর পশুগুলোর খাবার সংগ্রহের জন্য কৃষক এবং খামার মালিকদের মধ্যে রীতিমত হাহাকার পড়ে গেছে। ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান গত ২২ জুলাই বগুড়ার বন্যা কবলিত এলাকা সফরের সময় গো খাদ্যের সংকট মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপই দৃশ্যমান নয়। ফলে কোরবাণীর পশুগুলো নিয়ে কৃষক এবং খামার মালিকরা অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন। 
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসের প্রথম দিকে যমুনা ও বাঙালি নদীতে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ১৩ জুলাই দুপুর নাগাদ যমুনা নদী বিপদ সীমা অতিক্রম করে। এরপর টানা কয়েকদিন পানি বৃদ্ধির ফলে এক সময় এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ১২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। তবে প্রায় ৬দিন ধরে পানি বৃদ্ধিও পর গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যা থেকে যমুনার পানি কমতে শুরু করে। তবে ২৪ জুলাই দুপুর থেকে পর থেকে সেই যমুনার পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। বাড়ছে পাশের বাঙালি নদীর পানিও। যমুনা নদীর পানি বুধবার দুপুর ১২টায় বিপদ সীমার ১৪ সেন্টিমিটার এবং বাঙালির পানি ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে তীরবর্তী তিন উপজেলা সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের নিম্নাঞ্চল এবং চরাঞ্চলের ২ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, বাড়ি-ঘর এবং খামারে নদীর স্রোত ঢুকে পড়ায় ওই তিন উপজেলায় ১ লাখ ১২ হাজার গরু, ৫৬ হাজার ছাগল, ২৫ হাজার ভেড়া এবং ১ হাজার মহিষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি ৮৫ হাজার গরু, ৪৭ হাজার ছাগল এবং ২১ হাজার ভেড়া পানিবন্দী হয়ে পড়েছে সারিয়াকান্দি উপজেলা এলাকায়।
বগুড়া জেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় জানিয়েছে, বন্যার কারণে সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের ৩২০টি খামারের ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ৪ হাজার চারণ ভূমি প্লাবিত হয়েছে। এতে গবাদি পশুর অন্যতম প্রধান খাদ্য ঘাসের যোগান বন্ধ হয়ে গেছে। আর খড় ও ভুষিসহ অন্যান্য পশু খাদ্য নষ্টের পরিমাণ ৫ হাজার মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। ২টি গরুর মৃত্যু হয়েছে। টাকার অঙ্কে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি টাকার কাছাকাছি।
সারিয়াকান্দি উপজেলা সদরের দক্ষিণ হিন্দুকান্দি গ্রামের মোশারফ হোসেন জানান, কোরবাণীর হাটে বিক্রি করবেন বলে তিনি একটি ষাঁড় লালন-পালন করছিলেন। কিন্তু বাজারে ঘাস না মেলায় গরুকে নিয়মিত খাওয়াতে পারছেন না। একই গ্রামের আশরাফ আলী জানান, বাড়ি-ঘরে পানি ঢুকে পড়ায় গরুকে নিয়ে তিনি রাস্তার ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। ঘাস আর খড়ের অভাব দেখা দেওয়ায় তিনিও গরুকে প্রয়োজন অনুযায়ী খাওয়াতে পারছেন না। আশরাফ আলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভুষি কিনা যে খাওয়ামো তারও দাম খালি বাড়িচ্চেই। ঠিকমত খাবার দিবার পারিচ্চিনা তাই গরুর স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে। ইঙ্কা হলে কোরবাণীর হাটত তো দাম পামো না।’ ওই গ্রামের গরুর বেপারি ফেকু ফকির জানান, কোরবানীর হাটে বিক্রির জন্য তিনি ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় ছোট আকারের ৩টি গরু কিনেছিলেন। খাদ্যের অভাব হওয়ায় দু’দিন আগে সেগুলো ৬ হাজার টাকা লোকসানে অর্থাৎ ১ লাখ ৩৯ হাজার বিক্রি করে দিয়েছেন।
সারিয়াকান্দির যমুনার চরবেষ্টিত গ্রাম চরপাড়া ও মুলবাড়িতে গো খাদ্যের সংকট দেখা দেওয়ায় স্থানীয় একটি খামারের ৫০টি মহিষ নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন গোবিন্দ নামে এক রাখাল। বুধবার তিনি প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে গাবতলী উপজেলার অদ্দিরগোলা মাঠে অবস্থান করছিলেন। গোবিন্দ জানান, তাদের চরাঞ্চলে থৈ থৈ পানি। কোথাও এক ইঞ্চি শুকনো নেই। ক্ষুধার্ত মহিষগুলোকে খাওয়ানোর মত এক মুঠো ঘাসও নেই। তাই বাধ্য হয়ে আরও দুই সহযোগীকে নিয়ে তিনি মহিষগুলোকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘যেসব মাঠে ফসল আছে সেখানে জমির মালিকরা মহিষ নিয়ে ভিড়তে দিচ্ছেন না। ফলে সবখানে মহিষগুলো খাবারও পাচ্ছে না।’
বুধবার বেলা ১১টার দিকে গরু নিয়ে ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ি হাটে এসেছেন সারিয়াকান্দি উপজেলার সুতানাড়া গ্রামের উজ্জ্বল মিয়া। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী কেউ দাম না বলায় বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন নি। সেই একই হাটে তিনটি ছাগল নিয়ে এসেছেন কামালপুর ইউনিয়নের রৌহদহ গ্রামের রফিকুল ইসলাম। তিনিও কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা পাচ্ছেন না। 
ছাগল বিক্রি করতে আসা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কোরবানীর হাটত বেচমু জন্যি ৩ডা ছাগল পালছিলাম। কিন্তু এখন বাড়ি-ঘরে পানি ওঠার পর নিজেই খাবার পাই না ছাগলেক কি খাওয়ামু। তাই বেচপ্যার আচ্চি।’ স্থানীয় গরুর ব্যাপারী আব্দুল মোত্তালেব জানান, বন্যার কারণে যমুনা ও বাঙালি নদী তীরবর্তী বিশেষ করে চরাঞ্চরে গো-খাদ্যের সংকট দেখা দেয়ায় কেউ তাদের বাড়ি-ঘরে গরু-ছাগল রাখতে পারছেন না। যে কারণে তারা কমদামে গরু-ছাগল বেচতে বাধ্য হচ্ছেন।’
সোনাতলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. রহমত-উন-নবী জানান, নিয়মিত খাবার দিতে না পারলে গবাদিপশুগুলোর ওজন কমবে। কোরবাণীর পশুগুলোর ওজন কমলে কৃষক ও খামারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, সংকট মোকাবেলার জন্য খামার মালিকদের বিকল্প নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘গো খাদ্যের জন্য ১ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই তা বন্টন করা হবে।’