আমাদের মা জননী-৩১

মন্দ মন্দকে খোঁজে আর ভালো ভালোকেই কাছে টানে-২

জুবাইর হাসান মোহাম্মদ জুলফিকার আলী
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০১৯ ১২:০৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৪২৮ বার।

[গতকালের পর থেকে পড়তে হবে] 
হযরত আয়েশা রা:-কে চারিত্রিক অপবাদ দেয়ার ঘটনার সংশ্লিষ্টতায় মহান আল্লাহ তায়ালা বলছেনঃ
“দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্যে; দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্যে; সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্যে এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্যে। লোকে যা বলে এরা তা থেকে পবিত্র; এদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা। সূরা: আন নূর: ২৬।
হযরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন যে, এইরূপ মন্দ কথা মন্দ লোকদের জন্যেই শোভা পায়। ভালো কথা ভালো লোকদের জন্যেই শোভনীয় হয়ে থাকে। অর্থাৎ মোনাফেকরা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা; এর প্রতি যে অপবাদ আরোপ করেছে এবং তাঁর সম্পর্কে যে জঘন্য কথা উচ্চারণ করেছে সেটার যোগ্য তারাই। কেননা তারাই অশ্লীল ও ম্লেচ্ছ। আয়েশা রা: সতী সাধ্বী বলে তিনি পবিত্র কথারই যোগ্য। এই আয়াতটিও হযরত আয়েশা রা: এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়।১ খারাপ লোকেরাই খারাপ কথা প্রচার করে বেড়ায়। আর ভালো লোকদের কাছ থেকে ভালো কথাই প্রচারিত হয়। মোনাফেকরা হযরত আয়েশা রা:-এর ব্যাপারে যে জঘন্য কথা প্রচার করছিলো তা তাদের জন্যেই প্রযোজ্য ছিলো। তিনি তো উত্তম আমলকারীদের অন্যতম, তারা যা বলে তা থেকে তিনি অনেক উর্দ্ধের। “খারাপ নারীরাই খারাপ পুরুষদের জন্যে এবং খারাপ পুরুষেরাই খারাপ নারীদের জন্যে। অন্যদিকে মু’মিনা নারীরা মু’মিন পুরুষদের জন্যে এবং মু’মিন পুরুষরা মু’মিনা নারীদের জন্যে।” এই আয়াতটির পরিষ্কার অর্থ এই যে, আল্লাহর রাসূল হযরত মোহাম্মদ সা: যিনি সবদিক দিয়েই পবিত্র, তাঁর বিয়েতে যে আল্লাহ তায়ালা অসতী ও ম্লেচ্ছা নারী প্রদান করবেন এটা অসম্ভব। কলুষিতা নারী কলুষিত পুরুষের জন্যে শোভনীয়।২ এজেন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: 
“লোকে যা বলে তারা তা হতে পবিত্র।” এই দুষ্ট লোকদের মন্দ ও ঘৃণ্য কথায় তারা যে দু:খ কষ্ট পেয়েছে এটাও ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা লাভের কারণ। তাঁরা রাসূল সা: এর স্ত্রী বলে জান্নাতে তাঁর সাথে থাকবেন। [ইবনে কাসীর-১৫/১৪২]
রাসূল সা: বলেছেন: “আল্লাহর পছন্দ নয় যে, আমি জান্নাতী রমণী ছাড়া অন্য কাউকে বিবাহ করি”।৩ ইমাম বায়যাবী (মৃত্যুঃ ৬৮৫ হিজরি) লিখেছেনঃ ‘জননী আয়েশা রা:-এর ওপরে অপবাদ আরোপকারীদের যেভাবে ধমক ও হুমকি দেয়া হয়েছে, সে রকম কঠোর হুশিয়ারি কোরআন মজীদের অন্যত্র নেই।”৪
যাহোক, হযরত আয়েশা রা:-এর প্রতি মিথ্যা অপবাদ ঘটনা সম্পর্কিত সর্বশেষ এই আয়াতে (সূরা আন নূর এর ৩য় রুকুর ২৬নং আয়াতে) আল্লাহ তায়ালা মানব চরিত্রের একটা সহজাত ঝোঁক-প্রবণতা তুলে ধরেছেন। মানব চরিত্রের সেই ঝোঁক প্রবণতা অর্থাৎ নারী পুরুষের পারস্পরিক যোগসূত্রটা এই যে, ব্যভিচারিণী নারী ব্যভিচারী পুরুষের প্রতি এবং ব্যভিচারী পুরুষ ব্যভিচারিণী নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তেমনিভাবে সচ্চরিত্রা নারীর আগ্রহ সচ্চরিত্র পুরুষের প্রতি এবং সচ্চরিত্র পুরুষের আগ্রহ সচ্চরিত্রা নারীদের প্রতি হয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ আগ্রহ অনুযায়ী জীবন সংগী খোঁজ করে নেয় এবং প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী সে রূপই পায়। 
এই চিরাচরিত অভ্যাস ও রীতি থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, সকল নবীদের চারিত্রিক পবিত্রতা বাইরে ও ভেতরে উভয় ক্ষেত্রেই চরম উচ্চমানের ছিলো। আর সেজন্যেই আল্লাহ তায়ালা তাদের সবাইকে উত্তম চরিত্রের পতœী দান করেছিলেন। আর আমাদের নবী (সাঃ) তো ছিলেন পয়গম্বর কুলের শিরোমনি। তাঁর চারিত্রিক পবিত্রতা ও উৎকর্ষতার জন্যে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁরই মতো উত্তম চরিত্রের ভার্যাকুল (ভালোবাসার প্রিয়তমা স্ত্রীকুল) দান করেছেন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা: রাসূল সা:-এর বিবিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠা ও বিশিষ্টতমা ছিলেন। যে মানুষের স্বয়ং রাসুল (সা:) এর ওপর ঈমান নেই, সেই ব্যক্তিই হযরত আয়েশা রা: সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতে পারে। কোরআন পাকে বর্ণিত আছে যে, হযরত নূহ আ: ও হযরত লুত আ: এর বিবিগণ কাফের ছিলেন (সূরা আত তাহরীম: ১০)। কিন্তু তাদের সম্পর্কে একথাও প্রমাণিত আছে যে, কাফের হওয়া স্বত্ত্বেও তারা ব্যভিচার ও পাপাচারে লিপ্ত ছিলো না। হযরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, “কোনো পয়গম্বরের বিবি কোনোদিন ব্যভিচার করেনি।”৫ এ থেকে জানা গেলো যে, পয়গম্বরের বিবি কাফের হবে-এটাতো সম্ভবপর, কিন্তু ব্যভিচারিনী হবে-এটা সম্ভবপর নয়। কেননা ব্যভিচারিনী স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ঘৃণার পাত্র। কিন্তু কুফর স্বাভাবিকভাবে ঘৃণার কারণ হয় না।৬
[তথ্যসূত্রঃ ১. তাবারী ১৯/১৪২ (ইমাম ইবনে জরীর তাবারী, মৃত্যু: ৩১০ হিজরি) তাফসীরে ইবনে কাসীর ১৫/১৪২ (ইবনে কাসীর, মৃত্যু: ৭৭৪ হিজরি), দু’ররুল মানসুর ৬/১৬৭-ইমাম জালালুদ্দিন সূয়ূতি, মৃত্যু: ৯১১ হিজরি। ২. তাবারী ১৯/১৪৪; উদ্ধৃত: তাফসীরে ইবনে কাসীর-১৫/১৪২। ৩. ইবনে আসাকের, মৃত্যু: ৫৭১ হিজরি। উদ্ধৃতঃ তাফসীরে মাযহারী, ৮ম খন্ড-কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী, মৃত্যুঃ ১২২৫ হিজরি। ৪. তাফসীরে মাযহারী, ৮ম খন্ড। ৫. দুররুল মানুসর-জালালুদ্দিন সূয়ূতী, মৃত্যু: ৯১১ হিজরি। উদ্ধৃত: মা’ আরেফুল কোরআন ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৭৯। ৬. বয়ানুল কোরআন-আশরাফ আলী থানবী, মৃত্যু: ১৩৬২ হিজরি। উদ্ধৃত: মা’ আরেফুল কোরআন, ষষ্ঠ খন্ড।]

[পরবর্তী অংশ আগামীকাল]