আনন্দ-বেদনার ঈদ রোহিঙ্গাদের

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ অগাস্ট ২০১৯ ০৭:০৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৪৮ বার।

আনন্দ-বেদনার মাঝে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেছে কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা শিবিরে ঈদের নামাজ আদায়ের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন ইমাম ও মুসল্লিরা। মোনাজাতে অংশ নেওয়া মুসলিমরা নির্যাতনের বিচার চেয়ে ও নিজ দেশ মিয়ানমারে মর্যাদার সঙ্গে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেন।

এছাড়াও তাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সরকার-জনগণের প্রতি ধন্যবাদ জানান।

সোমবার সকাল সাড়ে ৭ টার দিকে টেকনাফ-উখিয়ার ৩০টির বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে এসব জামাত অনুষ্ঠিত হয়।

সরেজমিন ঈদের দিন টেকনাফের বিভিন্ন শিবির ঘুরে দেখা গেছে, শিশুরা সকাল থেকেই নিজের পরিস্কার জামা-কাপড় পরে সেজেগুজে শিবিরের রাস্তায় হৈহুল্লোড় আর আনন্দে মেতে উঠেছে। রোহিঙ্গাদের অনেককে নতুন জামা, গেঞ্জি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি ও চশমা পরে দলবেঁধে শিবিরে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। কিশোরীরাও নিজেদের সাজানোর চেষ্টা করেছেন মনের মতো করে। আবার অনেক শিশুকে খালি গায়ে দেখা গেছে। তবে বড়দের ঈদ উৎসবের আমেজ নেই, তাদের মনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে প্রাণ হারানো স্বজনদের দুঃসহ স্মৃতি! 

কক্সবাজারের ৩০টি রোহিঙ্গা শিবিরে এক হাজার ২০০টি মসজিদ ও ৬৪২টি নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ টেকনাফের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৭টি, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৬২টি ও ২৮টি নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব মসজিদ ও নুরানী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের জামায়াত আদায় করেছেন মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা। কিছু কিছু জায়গায় খোলা আকাশের নিচে নামাজ পড়তে দেখা গেছে। 

মোহাম্মদ মুজিব উল্লাহ, বয়স আনুমানিক ৭০। মংডুর এটিলিয়া পাড়া থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি বলেন, আগস্ট মাস রোহিঙ্গাদের জন্যা কালো, এ মাসে খুব কাছ থেকে দেখেছি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস রূপ। প্রায় দুই বছর আগে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে চোখের সামনেই সেনারা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে আমার তিন ছেলেকে। গুলি করে হত্যা করা হয় দুই ভাইয়ের ছেলেদের। ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। লুট করা হয় সহায় সম্বল। ঈদের দিন আসলে ওদের কথা মনে পড়ে। সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা বলতে বলতেই কেঁদে ওঠেন তিনি।

শরণার্থী জীবনে ‘টাকা-পয়সা নাই, চলাফেরার সুযোগ নাই’ মন্তব্য করে টেকনাফ লেদা ডেভলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম  বলেন, আমরা দেশে যেভাবে ঈদ করতাম, এখানে সেভাবে ঈদ করতে পারিনি। কারণ সবকিছুর পরও এটা আমাদের দেশ না। এই জন্য আমাদের কোনও আনন্দ নেই। তাছাড়া তার শিবিরের লোকজন কোরবানি পশু পায়নি। 

তিনি বলেন, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালায় সেদেশের সেনারা। এই মাস আসার পর থেকে যেন মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের কালো দিন এসেছে।

বড়দের মন খারাপ থাকলেও ঈদ উপলক্ষে খুব সকালে নতুন জামা পরে বেড়াতে বের হয়েছে রোহিঙ্গা শিশু জানি আলম (৮) ও মনির আলম (১০)। কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারা জানায়, আজ তারা সারাদিন ঘুরে বেড়াবে। আইসক্রিম আর চকলেট খাবে, দোলনায় চড়বে। খুব খুশি লাগছে। বন্ধুদের ঘরে যাবো আর রুটি ও মাংস খাওয়া হবে। 

কয়েকটি জায়গায় নাগরদোলা, চরকিসহ মিনিমেলা বসতে দেখা গেছে। তার মধ্যে মেলার আয়োজক আনোয়ার সাদেক জানান, মেলা তিনদিন থাকবে। গত বছরের তুলনায় শিশুরা এ বছর খুব সকাল থেকে নতুন জামা পরে আনন্দ করছে।

টেকনাফের জাদিমুড়া শিবিরের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ একরাম বলেন, আমরা আর কতদিন এ দেশের বোঝা হয়ে থাকব? জানি মিয়ানমার সেনারা হাজারো রোহিঙ্গা সদস্যকে হত্যা করেছে। তারপরও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের স্বদেশ, তাই আমরা ফিরতে চাই। তবে রোহিঙ্গাদের যেসব শর্ত রয়েছে, তা মানলেই সবাই ফিরে যাব।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রবিউল হাসান বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে সব রোহিঙ্গা শিবিরে ঈদের নামাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম জানান, ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং ব্যক্তি উদ্যোগে সাড়ে তিন হাজার কোরবানির পশু জবাই করা হয়েছে। সেগুলো জবাইয়ের পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং ক্যাম্প ইনচার্জদের তত্ত্বাবধানে মাংস বণ্টন করা হচ্ছে। 

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টে কোরবানি ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন শুরু করে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। পুরনোসহ উখিয়া-টেকনাফের ৩০টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তবে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।