কাশ্মীরে ঈদ: নেই পশু বেচাকেনা, হয়নি কোরবানি

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ অগাস্ট ২০১৯ ০৭:২৫ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১০৬ বার।

কোরবানির জন্য ভেড়াই অধিক পছন্দ কাশ্মীর উপত্যকার মুসলিমদের। কিন্তু ঈদের এক সপ্তাহ আগ থেকে কড়া সামরিক নিরাপত্তা জারি করায় এবার কোরবানির প্রস্তুতি নিতে পারেননি তারা। শ্রীনগরের বেশির ভাগ মসজিদে ঈদের জামাত আদায়েরও অনুমতি দেওয়া হয়নি কাশ্মীরিদের।

এএফপির এক প্রতিবেদনে উঠে আসে কাশ্মীরিদের এবারের ঈদ পালনের করুণ দৃশ্য।

রাজ্যের রাজধানী শ্রীনগরে সেনা নজরদারির মধ্যেই স্থানীয় বাসিন্দা বশির আহমদ বরাবরের মতো কোরবানির প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। শ্রীনগর শহরের বাইরে বশির আহমদের বাড়ি।

কয়েক দফা নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্ট এবং রাস্তায় পেতে রাখা কাঁটাতারের বেড়া পার হতে হয় তাকে। এভাবেই কড়া নিরাপত্তায় গাড়ি চালিয়ে ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভেড়া কিনতে শ্রীনগরে এসেছিলেন তিনি। 

পশু কেনার জন্য ছিল না প্রয়োজনীয় অর্থও। কোনো এটিএম বুথ কিংবা ব্যাংক খোলা পাননি তিনি। ফলে টাকাও তুলতে পারেননি কোনো।

পেশায় ব্যবসায়ী এই কাশ্মীরি বাসিন্দা আফসোস করে বলেন, ‘কোরবানির জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় বের হলাম, কিন্তু সবটাই বৃথা গেল।’

গত বছর কোরবানির জন্য পাঁচটি ভেড়া কিনেছিলেন তিনি। এবার একটিও কিনতে পারলেন না।

দুঃখ করে বশির বলেন, ‘এ বছর আর কোরবানি দেওয়া হলো না।’

এ পরিস্থিতি শুধু তারই নয়। কাশ্মীরিদের ঘরে ঘরে নেই ঈদের আনন্দ। পশু কোরবানি দেওয়ার কোনো প্রস্তুতিই নিতে পারেননি তারা।

আরেকজন বাসিন্দা শাকিল ভাট কোরবানির পশু কেনার জন্য ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে শ্রীনগরের বাজারে আসেন। কিন্তু বাজারে অল্প কিছু ভেড়া-ছাগলের উপস্থিতি দেখেন, তাও এত বেশি দাম, কেনার সামর্থ্যই নেই তার।

ব্যবসায়ীদের মত, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক কষ্টে বাজারে কোরবানির পশু এনেছেন তারা। দূরের পার্বত্য এলাকায় সারা বছর ভেড়া-ছাগল লালনপালন করে ঈদের বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছিলেন তারা। কিন্তু তাদের হাতে হতাশ হতে হলো।

ঈদের আগে কাশ্মীরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে গ্রামের বহু খামারি এবার শহরে গিয়ে কোরবানির পশু বিক্রি করতে পারছেন না। তারা বিরাট সঙ্কটে পড়েছেন।

কড়া নিরাপত্তার মধ্যে রিয়েসি শহর থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পথ হেঁটে শ্রীনগরে ১৫০টি ভেড়া বিক্রি করতে আনেন শমশের খান ও তার দুই ভাই।

শমশের খান বলেন, ‘মানুষের কাছে টাকা নেই। তাই এ বছর কোনো বেচাকেনাও নেই। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে বাড়িঘর থেকে কেউই বের হতে পারছেন না।’

তিনি বলেন, ‘কোরবানির পশু বিক্রি করেই সারা বছরের খোরাকি রোজগার করি আমরা। এটা ছাড়া আমাদের উপার্জনের আর কোনো উৎস নেই।’

শ্রীনগরের রাস্তায় একজন খামারি বলেন, ‘এবার কোনো ব্যবসা নেই। আমার মনে হয়না এবার কোনো পশু বিক্রি করতে পারবো। সকাল থেকে না খেয়ে আছি।’

কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে দেওয়ার পর জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করেন, হিমালয়ের এই উপত্যকা জঙ্গিবাদ ও বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগোবে এবার।

কিন্তু নয়াদিল্লি সরকারের সিদ্ধান্তকে কাশ্মীর উপত্যকায় অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দা শুজা রাসুল।

বত্রিশ বছর ধরে পশু কোরবানি দিয়ে আসছেন তিনি কিন্তু এবারের ঈদে অর্থের অভাবে কোরবানির পশু কিনতে পারেননি।

শুজা রাসুল বলেন, ‘আমরা এখন আর স্বাধীন নই। আমাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের স্বাধীনতা নেই। ভীষণ খারাপ লাগছে আমার।’

তবে কাশ্মীরের অধিকার কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ। পনেরো বছর ধরে পশু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এক ব্যবসায়ীর কণ্ঠে প্রতিশোধের স্পৃহা দেখে সেটি বোঝা গেল। 

ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি এখানকার পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক করে রেখেছেন, তা চিন্তার বাইরে।

তিনি বলেন, কারফিউটা তুলে দিলেই নিজেদের জীবন বিসর্জন দেব আমরা। যেভাবে ঈদে ছাগল কোরবানি দিই, ঠিক সেভাবে জাতির জন্য নিজেদের প্রাণ দিয়ে দেব।’

এনডিটিভি জানায়, শনিবার কারফিউ কিছুটা শিথিল করা হলেও রবিবার ফের কারফিউ জারি হওয়ায় ঈদের দিন জম্মু-কাশ্মীরের পথঘাট থমথমে, নির্জন ও নীরবতায় আচ্ছন্ন।

বিক্ষোভ সৃষ্টির আশঙ্কায় শ্রীনগরের বেশির ভাগ মসজিদে ঈদের নামাজ অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে আশপাশের ছোট কয়েকটি মসজিদে ঈদের নামাজে যেতে পেরেছেন মুসলিমরা।

স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গৃহবন্দি থাকা সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতিসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে স্থানীয় মসজিদে নামাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে ।

গত সোমবার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে অঞ্চলটি কার্যত পুরোপুরি দখলে নিয়ে নিল ভারত।

ইতিহাসের সবচেয়ে কঠোর সামরিক পরিস্থিতি জারি করা হয়েছে সেখানে। মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

গত এক সপ্তাহ ধরে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে অঞ্চলটিকে। সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহসহ ৪০০ স্থানীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে ভারত সরকার।

এ দিকে রাজ্যসভার এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফুঁসছে অঞ্চলটির জনগণ। কারফিউ ভেঙে এরই মধ্যে রাস্তায় নামা শুরু করেছে মানুষ। মঙ্গলবার রাত থেকে শ্রীনগরের বেশ কিছু জায়গা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।