এটিএম জালিয়াতি: তদন্তে আসছে এফবিআই

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭ অগাস্ট ২০১৯ ০৬:২৮ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৫ বার।

এটিএম বুথে জালিয়াতির ঘটনার তদন্তে ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) একটি প্রতিনিধি দল। কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় বুথ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে, এ ব্যাপারে তথ্য পেতে বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের সহায়তা করবে তারা। এফবিআই প্রতিনিধি দলে যারা আসছেন তারা বিশ্বব্যাপী এ ধরনের জালিয়াতি তদন্তে এরই মধ্যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এ ছাড়া নীতিনির্ধারকরাও জালিয়াত চক্রের হোতাদের শনাক্ত করে আগামীতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করার ওপর জোর দিচ্ছেন। বারবার এটিএম বুথে জালিয়াতির ঘটনায় গ্রাহকদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে এক ধরনের দুশ্চিন্তা। আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষও এটিএমের মাধ্যমে লেনদেন প্রক্রিয়ার আরও সুরক্ষা চায়। এফবিআইর কাছ থেকে পাওয়া নির্দেশনা এ খাতে কাজে লাগাতে চায় তারা। সর্বশেষ দেশে এটিএম বুথে যে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে আগেই বাংলাদেশকে সতর্ক করেছিল এফবিআই। তাই বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

চলতি বছরের ১ জুন রাত ৮টার দিকে খিলগাঁও থানাধীন তালতলা মার্কেটের বিপরীতে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের বুথে দুই বিদেশি নাগরিক মুখোশ ও টুপি পরা অবস্থায় বুথে ঢোকে। সিকিউরিটি গার্ড জালাল তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক বলে মনে করেন। এ সময় দু'জনকে ধরার চেষ্টা করলে তারা পালাতে চায়। এর পর স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় দেনিস ভেতোমস্কি নামে এক বিদেশিকে আটক করা সম্ভব হয়। খবর পেয়ে খিলগাঁও থানা পুলিশের একটি দলও সেখানে যায়। তখন জানা যায়, দেনিস ইউক্রেনের নাগরিক। পরে থানা পুলিশ, ডিবি ও সিআইডির একটি যৌথ দল দেনিসকে নিয়ে পান্থপথের ওলিও ড্রিম হোটেলে অভিযান চালায়। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় আরও পাঁচজনকে। তারা হলো– ভদ্মাদিমির ত্রিশেনসকি, নাজারি ভজনোক, সেরগেই উকরাইনেতসআলেগ শেভচুক, আলেগ শেভচুক ও ভাতালি কিলিমচুক। তারা সবাই ইউক্রেনের নাগরিক। তাদের কাছ থেকে ম্যাগনেটিক কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মোবাইল ফোন, ট্যাবসহ অন্যান্য আলামত উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার ছয় বিদেশিকে আদালতে হাজির করে প্রথমে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি। এর পর আরেক দফায় তাদের রিমান্ডে নেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।

ডিবি ও সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ভাষাগত জটিলতার কারণে ইউক্রেনের ছয় নাগরিককে জিজ্ঞাসাবাদ করে বেশি তথ্য বের করা সম্ভব হয়নি। এফবিআইর যারা ঢাকায় আসছেন তারা একাধিক ভাষা জানেন। একই ধরনের ঘটনায় ইউক্রেনের নাগরিকদের জিজ্ঞাসাবাদের অভিজ্ঞতাও তাদের রয়েছে। বিশ্বব্যাপী যারা ব্যাংকিং খাতের নানা জালিয়াতিতে জড়িত, এমন ব্যক্তিদের ওপর নজর রাখে তারা।

সিআইডির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, জালিয়াত চক্রের সদস্যরা ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের মোট ৯টি বুথে হানা দেয়। যদিও প্রথমে ৭টি বুথের কথা গোপন করে আসছিল। পরে তদন্তে উঠে আসে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ৯টি বুথ থেকে মোট ১৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। তবে কোন প্রক্রিয়ায় তারা এটিএম সিস্টেম হ্যাক করেছিল, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদিও পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, এটিএমের পুরো সিস্টেম হ্যাক করতে পেরেছিল ওই চক্র। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে দাবি করছে, এ চক্রের সদস্যরা শুধু বুথের নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছিল। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে জব্দ ৩০টি এটিএম কার্ড বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।

দায়িত্বশীল আরও একটি সূত্র জানিয়েছে, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের বুথের জালিয়াতির সঙ্গে সংঘবদ্ধ বিদেশি প্রতারক চক্র জড়িত। গ্রেফতার ছয়জন ছাড়াও এ চক্রের আরও অনেকে রয়েছে। এমনকি তাদের সহায়তায় বাংলাদেশি কোনো নাগরিকও জড়িত বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। এ ছাড়া ইউক্রেনের পুরো চক্রকে শনাক্ত করতে ঘটনার আগের তিন মাসে ওই দেশের কোন কোন নাগরিক বাংলাদেশে এসেছে, তার তালিকা তৈরি করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের মধ্যে সন্দেহভাজনদের আলাদা করতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা-ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।

পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত তারা নিশ্চিত হয়েছে– ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের বুথের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিল উত্তর কোরিয়ার একটি হ্যাকার গ্রুপ। তবে 'হিডেন কোবরা' নামে ওই গ্রুপ সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের কাছে। এ ব্যাপারে তারা এফবিআইর সহায়তা নিতে চায়। এ ছাড়া এবার এটিএম জালিয়াতির ঘটনার আগেই এফবিআই ওই জালিয়াত চক্রের ব্যাপারে আগাম সতর্ক করেছিল বাংলাদেশকে। ওই সতর্কবার্তা পাওয়ার পরই সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে অবহিত করা হয়।

পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, এটিএম জালিয়াতির পর সার্বিক তদন্তের অংশ হিসেবে যেসব বুথে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, তার মেশিনপত্রের ফরেনসিক পরীক্ষা শুরু করেছে সিআইডি। এই জালিয়াতি রহস্য উদ্ঘাটনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), কম্পিউটার কাউন্সিল পুলিশকে সহযোগিতা করছে। এটিএম বুথের মেশিনপত্রের ডুপ্লিকেট ভার্সন তৈরি করে ফরেনসিক প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার কাজও শুরু করেছেন গোয়েন্দারা।

জানা গেছে, ২০১৬ সালেও দেশে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এটিএম বুথে ক্লোন কার্ড ব্যবহার করে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। তথ্য চুরি ও কার্ড ক্লোন হয়েছে ৩৬টির মতো কার্ডে। এই প্রক্রিয়ায় ২০ লাখের মতো টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পুলিশ তখন জানায়, এটিএম বুথগুলোতে স্কিমিং যন্ত্র বসিয়ে কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা ওঠানোর সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের কয়েকজন নাগরিক সংশ্লিষ্ট।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, এটিএম জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত চক্রকে শনাক্ত করতে একাধিক টিম কাজ করছে। যাদের এ ধরনের অপরাধীদের শনাক্ত করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের সহায়তা নেওয়া হবে।

ডিবির খিলগাঁও জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুর রহমান সমকালকে বলেন, ফরেনসিক প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। সেটা পাওয়া গেলে জালিয়াত চক্রের কাজের ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা সগীর আহমেদ বলেন, জুনের ঘটনার পর ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের সব বুথের সার্বিক নিরাপত্তা আরও বাড়ানো হয়েছে। একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে, যারা রাতে বুথগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করবে।