অর্ধেকও বেশি মার্কিনিদের বিশ্বাস, ৯/১১ হামলা নিয়ে তথ্য গোপন করেছে সরকার

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৩:৫৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৩৮ বার।

কারা ঘটিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ ওয়ান ইলেভেনের ঘটনা। ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীরা নাকি মার্কিন সরকার বা ইসরায়েলি গোয়েন্দা বাহিনী এর সঙ্গে জড়িত ছিল?

নতুন শতাব্দীর শুরুতে পৃথিবীর আলোচিত এই ঘটনা নিয়ে আছে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে ইসলামি সন্ত্রাসীরা চারটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে। এর দুটি আঘাত করে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবনে, একটি আঘাত করে ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে এবং আরেকটি পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার লোক নিহত হয়।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে আসে এই সন্ত্রাসী হামলাকে ঘিরে চালু থাকা কিছু ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’। যেমন, মার্কিন সরকার বা ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা এ হামলার পেছনে ছিল, ওই আক্রমণে কোনো ইহুদি মারা যায়নি, আসলে কোনো বিমান টুইন টাওয়ারে বা পেন্টাগনে আঘাত করেনি - এই রকম অনেক কিছু।

আরেকটি বড় তত্ত্ব হচ্ছে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দুটি টাওয়ার ধসে পড়েছিল বিমানের আঘাতে নয় বরং ভবনটির ভেতরে বিস্ফোরক বসিয়ে তা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। টুইন টাওয়ার হামলার ১৮ বছর পার হয়ে গেলেও এসব তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক শেষ হয়নি।

টুইন টাওয়ারে হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ছড়ায় প্রথম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। ডেভিড রস্টচেক নামের এক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী লিখলেন, “কেউ কি খেয়াল করেছেন যে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবনটি বিমানের আঘাতে ধ্বংস হয়নি? নাকি শুধু আমিই এটা বুঝেছি?”

তার ভাষ্য ছিল, “ভবন দুটিতে বিমান আঘাত করেছে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এটা ঠিক কথা, কিন্তু যেভাবে টাওয়ার দুটি ভেঙে পড়েছে তার জন্য এর ভেতরে সঠিক জায়গায় বিস্ফোরক বসানো লাগত। এ কাজটা করতে হলে কাউকে অনেক সময় নিয়ে করতে হবে।”

পরে অবশ্য তদন্ত করে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বিমানের আঘাতের পর আগুনে টাওয়ার দুটির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ওপরের তলাগুলো ভেঙে পড়তে থাকলে তার চাপে পুরো ভবনটিই ভেঙে পড়ে যায়।

কিন্তু এখনো কিছু লোক আছেন যারা এ কথা বিশ্বাস করেন না। সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ লানজারোটেতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন ম্যাট ক্যাম্পবেল। তার স্ত্রী দোকান থেকে কেনাকাটা করে ফিরে এসে জানালেন, নিউইয়র্কে কিছু একটা ঘটেছে। টিভি খুলেই তারা হামলার খবর দেখলেন।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা খবর পেলেন যে, ম্যাটের ভাই জেফ নাকি ওই সময় উত্তর দিকের টাওয়ারে ছিলেন। এরপর থেকে জেফের আর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।

জেফ তার কয়েক বছর আগে থেকেই নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে বাস করছিলেন। কাজ করতেন রয়টার্স বার্তা সংস্থায়। নর্থ টাওয়ারে ১০৬ তলায় একটি সম্মেলন চলছিল, সেখানেই ছিলেন তিনি।

নিউইয়র্কে গিয়ে নানা হাসপাতালে খোঁজ নিলেন তারা। কোনো লাভ হলো না। তারা বুঝলেন, জেফ মারা গেছে।

শেষে ২০০২ সালে তার কাঁধের হাড়ের একটি অংশ পাওয়া যায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ধ্বংসস্তূপে। তবে ওই ঘটনার তদন্ত শেষ হয় ২০১৩ সাল নাগাদ।

এর মধ্যেই ম্যাটের মনে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার সরকারি ভাষ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। ম্যাট নিশ্চিত হলেন, তার ভাইয়ের মৃত্যু ঠিক কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে বহু কিছু আসলে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে, অনেক প্রশ্নের তিনি উত্তর পাচ্ছেন না।

ম্যাট বলেন, “২০০১ সালের অক্টোবর থেকেই এটা শুরু হয়েছিল। যতই দিন যাচ্ছে, আমি দেখলাম নানা রকম অসংগতির সংখ্যা বাড়ছে।”

ম্যাট বলছেন, “তিনি তথ্য জানার অধিকার সংক্রান্ত আইনের আশ্রয় নিয়ে এফবিআই এবং অন্য তদন্তকারী সংস্থার কাছে ওই ঘটনার বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা নানা কারণ দেখিয়ে তথ্য জানায়নি।”

স্বজনহারা এই ব্যক্তির ভাষ্য, “আমি এখনো তাদের কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ পাইনি।”

শুধু জেফ নন, ক্যালিফোর্নিয়ার চ্যাপম্যান বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৬ সালে এক জরিপ চালিয়ে বলেছে, অর্ধেকেরও বেশি মার্কিন নাগরিক বিশ্বাস করে যে সরকার ৯/১১-র ঘটনা সম্পর্কে তথ্য গোপন করছে।

কোনো কোনোটিতে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার নিজেই ওই ঘটনায় জড়িত ছিল। কেউ বলেন, মার্কিন কর্মকর্তারা ইচ্ছে করেই আক্রমণটি ঘটতে দিয়েছেন। অন্য অনেকে বলেন, ঘটনার পরিকল্পনাতেই সরকার জড়িত ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, “ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলো ছড়িয়েছে এই জন্য যে মাত্র কয়েকজন লোক মিলে অতি সাধারণ অস্ত্র দিয়ে এ রকম ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে তা লোকে বিশ্বাসই করতে পারে না।”

কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কারেন ডগলাস বলেন, “যখন কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে তখন লোকেরা এর একটা ব্যাখ্যা পেতে চায়। কিন্তু অনেক সময়ই সরকারি ব্যাখ্যা লোককে সন্তুষ্ট হতে পারে না।”

তিনি বলেন, “তারা চায়, ঘটনা যে মাপের - ব্যাখ্যাটাও সেই মাপের হতে হবে। সেটা না পেলেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম হয়।”

অধ্যাপক ডগলাস আরও বলেন, “ইন্টারনেটে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব তথ্য এমন লোকদের মধ্যেই শেয়ার হয় যাদের চিন্তাভাবনা একই ধরনের।”

বেশ কিছু বই ও চলচ্চিত্রও এসব চিন্তাকে উসকে দিতে সহায়তা করেছে। যেমন, ডেভিড রে গ্রিফিন নামে দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক ২০০৪ সালে একটি বই লেখেন- ‘দ্য নিউ পার্ল হারবার’ নামে। এতে তিনি ৯/১১-র ঘটনায় মার্কিন সরকারের জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন।

পরিচালক ডিলান এভারির ‘লুজ চেঞ্জ’ নামের ধারাবাহিক সিরিজের প্রথম পর্বটি প্রচার হয় ২০০৫ সালে। এতে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা নিয়ে যেসব ‘জনপ্রিয়’  ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আছে তার মধ্যে বেশ কয়েকটি স্থান পায়।

কোটি কোটি লোক এগুলো দেখেছে, ইন্টারনেটে শেয়ার করেছে। এমনকি ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর তার বাড়িতেও এর একটি ডিজিটাল কপি পাওয়া গেছে।

২০০৬ সালে রিচার্ড গেগ নামে একজন ক্যালিফোর্নিয়ার স্থপতি ৯/১১ এর ঘটনার সত্য প্রকাশের জন্য স্থপতি ও প্রকৌশলীদের একটি গ্রুপ গঠন করেন যার নাম ‘এ ই নাইন ইলেভেন ট্রুথ’। তারা ওই দিনের ঘটনার সরকারি বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা নিয়ে বিবিসির রিপোর্ট নিয়েও বহু প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিল।

ঘটনাটি হচ্ছে, সেদিন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দুটি টাওয়ার ছাড়া ১০০ মিটার দূরের ডব্লিউটিসি নামে আরেকটি ৪৭ তলা ভবনও ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু ওই ভবনটিতে বিমানের আঘাত লাগেনি।

তবে ওই ভবনটি ভেঙে পড়া নিয়ে বিবিসির একটি রিপোর্টেও বিভ্রান্তি ও প্রশ্ন তৈরি হয়। ভবনটি আসলে যখন ভেঙে পড়েছিল তার ২০ মিনিট আগেই বিবিসির একটি রিপোর্টে ভবনটি ভেঙে পড়ার খবর দেওয়া হয়।

তবে ২০০৮ সালে আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ডস ও টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের এক রিপোর্টে বলা হয়, আগুন লেগে ভবনটির একটি প্রধান স্তম্ভ ভেঙে পড়ার পর পুরো ভবনটিই ভেঙে পড়ে।

তবে এ রিপোর্টও ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের খুশি করতে পারেনি। ম্যাট ক্যাম্পবেলও এখনো তার প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

ওই আক্রমণের মূল হোতা খালিদ শেখ মোহাম্মদের এক বিচার-পূর্ব শুনানিতে হাজিরা দেওয়ার জন্য গুয়ানতানামো বে-তে গিয়েছিলেন তিনি। সেই শুনানিকে ‘এক প্রহসন’ বলে আখ্যায়িত করেন ম্যাট ক্যাম্পবেল।