নতুন বাজার নেপাল

বগুড়া থেকে এবার ভুট্টা  রপ্তানি শুরু: কৃষক খুশি

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৯:৪০ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৬৪১ বার।

বগুড়া থেকে এবার ভুট্টা রপ্তানি শুরু হয়েছে। গেল এক মাসে বগুড়া থেকে ১ হাজার ২০ মেট্রিক টন ভুট্টা নেপালে রপ্তানি হয়েছে। যার মূল্য ২ লাখ ৪২ হাজার মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ কোটি টাকার কিছু বেশি। বগুড়ার দু’টি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র মাধ্যমে ওই পরিমাণ ভুট্টা রপ্তানি করেছে। 
বগুড়ায় রপ্তানীকারকরা জানিয়েছেন, মূলত ভারতের বাজারে দাম বেশি হওয়ার কারণেই নেপালের পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে ভুট্টা কেনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। গেল মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়বে জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নেপালের পোল্ট্রি শিল্পের পুরোটাই আমদানি নির্ভর। বাংলাদেশের ভুট্টার দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় তারা এখন ভারতের পরিবর্তে নতুন বাজার হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে। ভুট্টা রপ্তানীর খবরে স্থানীয় চাষীরা বেশ আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তারা মনে করেন রপ্তানী অব্যাহত থাকলে কৃষক ভাল দাম পাবেন, ফলে আবাদও বাড়বে। এতে ধানে লোকসান দেওয়া কৃষক ভুট্টা আবাদ করে তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।
বগুড়া থেকে সাধারণত রাইস ব্র্যান ক্রুড অয়েল, পাটের তৈরি বস্তা ও সুতলী, পানি সেচের পাম্প এবং তৈরি পোষাক রপ্তানী হয়ে থাকে। ২০১৮ সালে ৩ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ ২৮০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানী হয়েছে। আর চলতি বছরের শুরু থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে রপ্তানী হয়েছে ৪ কোটি ৮ লাখ ৩৭ হাজার মার্কিন ডলার বা প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানী হয়েছে। আগের পণ্যের সঙ্গে ভুট্টা যোগ হওয়ায় চেম্বার নেতৃবৃন্দ বলছেন, বছর শেষে রপ্তানীর পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। 
বগুড়ায় ভুট্টার চাষ শুরু হয় গেল শতাব্দীর নব্বই-এর দশকের গোড়ার দিকে। জেলার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দুই উপজেলা ধুনট ও শেরপুরেই প্রথম এর আবাদ শুরু হয়। পরবর্তীতে সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনা নদীর চরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পোল্ট্রি শিল্পের ব্যাপক প্রসারের কারণে ভুট্টার আবাদও বাড়তে থাকে। 
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী এ জেলায় গেল এক দশকে ভুট্টার আবাদ ২৬০ শতাংশ বেড়েছে। ১৯৯৮ সালে জেলায় ভুট্টার আবাদ হতো মাত্র ২ হাজার ১৬৪ হেক্টর জমিতে। আর ২০১৮ সালে তা প্রায় ৮ হাজার হেক্টরের কাছাকাছি পৌঁছেছে। আবাদের সঙ্গে সঙ্গে হাইব্রিড বীজের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় হেক্টর প্রতি ভুট্টার ফলনও প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। দশ বছর আগে প্রতি হেক্টর জমিতে ভুট্টার ফলন মিলতো ৪ দশমিক ৭০ মেট্রিক টন। ওই একই পরিমাণ জমিতে ২০১৮ সালে ফলন এসেছে প্রায় ৮ মেট্রিক টন করে। ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলায় ভুট্টার উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৮ সালে বগুড়ায় যেখানে ১০ হাজার ১৮৭ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদিত হতো, দশ বছরের ব্যবধানে তা ৫১৪ শতাংশ বেড়ে ৬২ হাজার ৩০৪ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে।
জমি না বাড়লেও বগুড়ায় ভুট্টার চাষ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন জানান, যখন যে ফসলে দাম ভাল পাওয়া যায় তখন কৃষকরা সেই ফসলের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধানের আবাদে কৃষক খুব একটা লাভ করতে পারছেন না। ধান চাষে যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন হয় তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ পানিতেই ভুট্টা আবাদ করা সম্ভব। যে কারণে এর উৎপাদন খরচও কম। আর ফলন বেশি হয় বলে লাভও বেশি- এসব কারণে কৃষক ভুট্টা আবাদে ঝুঁকে পড়েছেন।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের নলবাড়িয়া গ্রামের কৃষক জয়নাল আবেদীন জানান, গেল দু’ বছর ধানের আবাদে লাভের মুখ দেখতে না পাওয়ায় তিনি ভুট্টা চাষ শুরু করেছেন। একই উপজেলার গজারিয়া গ্রামের আবু হানিফ জানান, ধানের তুলনায় ভুট্টা চাষ বেশ লাভজনক। কারণ ভুট্টা আবাদে রোগ বালাই নেই বললেই চলে। প্রতি বিঘা জমিতে ৪০ থেকে ৪৫ মণ ভুট্টার ফলন পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা মণ দরে ভুট্টা বিক্রি করা যায়। ফলে লাভটাও ভাল থাকে। পাশাপাশি ভুট্টার গাছ জ্বালানী, গো-খাদ্য প্রভৃতি কাজে যেমন  ব্যবহার করা যায় তেমনি অন্য ফসলের সঙ্গে সাথী ফসল হিসাবেও ভুট্টা আবাদ করা যায়। যদি ভুট্টা নিয়মিতভাবে রপ্তানী করা যায় তাহলে আমাদের মত কৃষকরাই লাভবান হবে।’
জেলায় ভুট্টার সবচেয়ে বড় আড়ৎ শেরপুরের মেসার্স মেহেদী টেড্রার্সের স্বত্বাধিকারী দবিবুর রহমান জানান, এ অঞ্চলে উৎপাদিত ভুট্টার মান ভাল। যে কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ অঞ্চলের ভুট্টার বেশ চাহিদা রয়েছে। অপর আড়ৎ মালিক গোলাম মোস্তফা বলেন, বগুড়ায় উৎপাদিত ভুট্টাগুলো ফিডমিলের মালিকরাই কিনে থাকেন।
বগুড়া থেকে যে দু’টি প্রতিষ্ঠান নেপালে ভুট্টা রপ্তানী করছে তাদের একটি মেসার্স কিবরিয়া ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বাহার জানান, নেপালের পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা সাধারণ ভারত থেকেই ভুট্টা আমদানি করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে ভুট্টার দাম বেশি হওয়ায় তারা বিকল্প বাজার খোঁজা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘নেপালে চাহিদার কথা জানার পর আমরা গত জুলাই মাসে বগুড়া থেকে এবং পারে দিনাজপুর অঞ্চল থেকে ভুট্টা কিনে রপ্তানী শুরু করি। প্রতি টন ভুট্টা আমরা ২৫০ ডলারে রপ্তানী করছি।’ ৩১ জুলাই থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ৩টি চালানে ৮৬০ মেট্রিক টন ভুট্টা রপ্তানীর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চলতি সেপ্টেম্বরে আরও ভুট্টা রপ্তানী হবে এবং এটা অব্যাহত থাকবে।’
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান মিলন বলেন, ‘আগে ভুট্টার উৎপাদন কম ছিল। যে কারণে আমাদের দেশে চাহিদার সিংহভাগ ভুট্টাই বিদেশ থেকে আমদানী করতে হত। কিন্তু এখন পরিমাণে অল্প হলেও ভুট্টার রপ্তানী শুরু হয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি বগুড়াসহ রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে যে পরিমাণ ভুট্টা উৎপাদিত হয় তার একটা বড় অংশ রপ্তানী করা সম্ভব। এটা অবশ্যই আমাদের কৃষক তথা অর্থনীতির জন্য একটি সুসংবাদ।’