শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:০৮ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১১৪ বার।

চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনার মুখে থাকা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামের কাছে গিয়ে চাঁদা দাবির গুরুতর অভিযোগ নিয়ে কয়েকদিন ধরেই আলোচনা-সমালোচনা চলে আসছিল। এই দুই নেতা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন আদায় করে দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও দু'জনই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন।

এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ নিয়েও আলোচনার ঝড় বইছিল। যার মধ্যে রয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তিদের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেওয়া ও অনৈতিক আর্থিক লেনদেন, সম্মেলনের পরও একাধিক শাখায় কমিটি না দেওয়া, বিলাসী জীবন, দুপুরের আগে ঘুম থেকে না ওঠা, গণমাধ্যমকর্মীদের এড়িয়ে চলা কিংবা ফোন না ধরা, সংগঠনের একাধিক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েও নির্ধারিত সময়ের অনেক পর উপস্থিত হওয়া অথবা অনুপস্থিত থাকা ইত্যাদি অভিযোগ। এসব নিয়ে সমালোচনামুখর ছিলেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সেইসঙ্গে ছাত্রলীগ সভাপতির বিয়ের অভিযোগের প্রমাণ মেলে। পাশাপাশি দুই নেতার বিরুদ্ধে ওঠা সংগঠনের নেত্রীদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার অভিযোগও ওঠে।

গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ড ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভায় শোভন ও রাব্বানীর বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় দু'জনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও বিভিন্ন অভিযোগের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন ক্ষোভ প্রকাশের খবরে তোলপাড় চলছিল কয়েকদিন ধরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর লেখালেখিও হয়। বিতর্কিত নেতাদের সরাতে ও সংগঠনকে গতিশীল করতে ছাত্রলীগের আগাম সম্মেলনের দাবি তুলে ধরেন অনেকেই। কেউ কেউ সম্মেলন ছাড়াই শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিরই যোগ্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার দাবি জানান। শেষ পর্যন্ত সে রকম সিদ্ধান্তই এসেছে।

শোভন ও রাব্বানীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে এখনও নানা আলোচনা-সমালোচনা চলেছে। এ নিয়ে শোনা যাচ্ছে নানা গুঞ্জন। শুক্রবার রাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে রাব্বানীর উদ্দেশে বিস্টেম্ফারক বক্তব্য দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ জয়নুল আবেদিন রাসেল। রাব্বানীর বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে শেখ রাসেল ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, নতুন ক্যাম্পাসের বালু ভরাটের জন্য একজন ঠিকাদার পাঠানো ও তাদের কমিটি বিলুপ্ত না করে আবার ফিরিয়ে দিতে অর্থ দাবি করেছিলেন রাব্বানী। এসব অভিযোগের ব্যাপারে তার কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে বলে তিনি দাবি করেন। কেরানীগঞ্জে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস স্থাপনে ২০০ একর জমিতে নতুন প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ কমিটির নেতারা সন্তুষ্ট ছিলেন না বলে উল্লেখ করেন রাসেল।

অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাব্বানী। তার দাবি, অনেক তদবির করে কমিটি টিকিয়ে না রাখতে পেরে অপপ্রচার চালাচ্ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিলুপ্ত কমিটির নেতারা। তারা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নিয়ে সবসময়ই ফেসবুকে নানা বিরূপ মন্তব্য করে যাচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনে নিজের কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (এসি) লাগিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েনগোলাম রাব্বানী। তিন দশক পর ডাকসু নির্বাচনের পর ছয় মাস পার হতে চললেও প্রকট আবাসন সংকটসহ শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি পূরণে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা না থাকলেও ব্যক্তিগত আরামের জন্য ডাকসুর সাধারণ সম্পাদকের (জিএস) এমন আয়োজনকে ভাল চোখে দেখছেন না সমালোচকরা। তবে রাব্বানীর দাবি, অত্যাধিক গরমের কারণে এক ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’র তাকে ‘উপহার’ হিসেবে এসি লাগিয়ে দিয়েছেন। ডাকসুর অন্য পদাধিকারীরা চাইলে তাদের জন্যও এসি দিতে তিনি রাজি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, আরাম-আয়েশ করার জন্য শিক্ষার্থীরা তাকে ডাকসুর জিএস নির্বাচিত করেনি। নিজের কক্ষে এসি লাগানোর আগে শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল তার।

অগাস্টের শুরুর দিকে রাব্বানীর অফিস কক্ষে তার ‘শুভাকাঙ্ক্ষীর’ দেওয়া এই এসি লাগানো হয়। তবে ডাকসুর ভিপি, এজিএসসহ অন্যান্য সম্পাদকদের কক্ষগুলোতে কোনো এসি লাগানো হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগের পদ পাওয়ার পর থেকেই রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী রাজধানীর কাঁঠালবাগান ও হাতিরপুলে যথাক্রমে ৭০ হাজার ও ৪০ হাজার টাকার ভাড়া ফ্লাটে জীবনযাপন শুরু করেন। গত বছর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরদিন থেকে রাব্বানী টয়োটা কোম্পানির নোয়া মডেলের একটি মাইক্রোবাস ব্যবহার করতে শুরু করেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরাই ছাত্রলীগ নেতাদের ত্যাগী, উচ্চ আদর্শ ও সাদামাটা জীবনযাপন করার নির্দেশ দেন। কিন্তু সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ তিনি। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে আসে। শনিবার আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা শোভন ও রাব্বানীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ এবং অসন্তোষও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, গুরুতর অভিযোগের পর তাদের আর দায়িত্বে রাখা যায় না। ঐতিহ্যবাহী  সংগঠন ছাত্রলীগের এই দুই নেতার এমন আচরণ সত্যিই কষ্টের। তিনি বলেন, আমিই তাদের নেতা বানিয়েছি। আর আমার ছাত্রলীগের এই নেতারাই অপকর্মে জড়িত হয়েছে। এটা মানা যায় না।

শেখ হাসিনা বলেন, কোনো বাড়াবাড়িই ঠিক নয়। ওরা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামের সঙ্গে শোভন ও রাব্বানীর দুর্ব্যবহার ও চাঁদা দাবির প্রসঙ্গও তুলে ধরেন বলে বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের কয়েকজন জানিয়েছেন। খবর সমকাল অনলাইন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম শনিবার নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, শোভন ও রাব্বানী তার সঙ্গে দেখা করে ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশন আদায়ের জন্য চাপ দিয়েছিলেন। উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা গল্প ফেঁদেছে। এ বিষয়ে তিনি তাদের চ্যালেঞ্জ করেন। ঘটনাটি তদন্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও আচার্যকে অনুরোধ করবেন বলেও জানান ফারজানা ইসলাম। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে গোলাম রাব্বানী পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। তিনি বলেন, ঠিকাদারের কাছে কমিশন চেয়েছেন, এমন প্রমাণ থাকলে উপাচার্য তা তুলে ধরুক।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে রোববার ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে একাধিকবার ফোন দিলেও তারা ফোন ধরেননি।

এ দিকে দায়িত্ব পাওয়ার পর শনিবার দিবাগত রাত একটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসির) ডাচে আলাদা আলাদা মোটরসাইকেলে করে আসেন নতুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের সামনেই নেতাকর্মীরা ‘জয় ভাইয়ের আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে শোভন বলেন, শোনো, অতিরঞ্জিত হয় এমন কিছু করবা না। যেটা আমাদের কষ্ট দেয়, শেখ হাসিনাকে কষ্ট দেয়। ঠিক আছে, সবাই ভালো থাকবে।