মিন্নির জবানবন্দি ফাঁস: ত্রিভুজ প্রেমের বিবরণ

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৪:১৪ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ২৯৬ বার।

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ফাঁস হয়েছে।

তবে জবানবন্দি শেষে মিন্নির পরিবার জেলহাজতে তার সঙ্গে দেখা করার পর এ জবানবন্দি জোর করে নেয়া হয়েছে বলে দাবি করে আসছেন।

এ মামলায় বর্তমানে জামিনে আছেন মিন্নি। উচ্চ আদালতে জামিন নেওয়ার সময় মামলায় মিন্নির রিমান্ডসহ জবানবন্দি নিয়ে সমালোচনা হয়।  

মিন্নির বাবা মোজ্জাম্মেল হোসেন কিশোর এবং মা মিলি আক্তার শুরু থেকেই এ জবানবন্দি জোর করে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি জানিয়ে আসছেন।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে যা বলেছেন মিন্নি:

আমি বরগুনা সরকারি কলেজে ডিগ্রি ১ম বর্ষে পড়ালেখা করি। আমি ২০১৮ সালে বরগুনা আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। আইডিয়াল কলেজে পড়াশোনা কালীন ২০১৭ সালে আমার প্রেমের সম্পর্ক হয়। ওই সময় রিফাত শরীফ বামনা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছিল। রিফাত শরীফ ও নয়ন বন্ড পরস্পর বন্ধু ছিল। রিফাত শরীফ আমাকে তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, নয়ন বন্ড তাদের একজন।

কলেজে যাওয়া-আসার পথে নয়ন বন্ড আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে জ্বালাতন করত। আমি তার প্রেমের প্রস্তাবে সায় না দেওয়ায় সে আমার বাবা ও ছোট ভাইকে ক্ষতি করার ভয় দেখাত। বিষয়টি আমি রিফাত শরীফকে জানাই নাই।

আমি রিফাত শরীফকে ভালোবাসতাম কিন্তু রিফাত শরীফ অন্য মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক করার কিছু বিষয় আমি লক্ষ্য করি এবং এ কারণে রিফাতের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কিছু অবনতি ঘটে এবং আমি ধীরে ধীরে নয়ন বন্ডের দিকে ঝুঁকে পড়ি এবং নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

আমি নয়নের মোবাইল নম্বরে আমার মায়ের মোবাইল নম্বর এবং নয়নের দেওয়া নম্বর ও অন্য একটি নম্বর দিয়ে নয়নকে কল, ম্যাসেজ পাঠাতাম এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারে কল দিতাম।

বরগুনা সরকারি কলেজে পড়াশোনাকালীন ধীরে ধীরে রিফাত ফরাজী, রিফাত হাওলাদার ও রাব্বি আকনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ডের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। প্রেমের সম্পর্কের কারণে নয়ন বন্ডের বাসায় আমার যাতায়াত ছিল। নয়নের বাসায় দু’জনের শারীরিক সম্পর্কের কিছু ছবি-ভিডিও নয়ন গোপনে ধারণ করে। যা আমি প্রথমে জানতাম না।

নয়নের বাসায় আমি প্রায়ই যেতাম এবং আমাদের শারীরিক সম্পর্ক চলতে থাকে।

এরপর গত ১৫/১০/১৮ তারিখ আমি রোজী আন্টির বাসায় যাওয়ার পথে বিকেল বেলা ব্যাংক কলোনি থেকে নয়ন বন্ড রিকশাযোগে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। নয়নের বাসায় গিয়ে আমি শাওন, বাবু, রিফাত ফরাজী এবং আরও সাত/আটজনকে দেখি। শাওন বাইরে গিয়ে কাজি ডেকে আনে এবং নয়নের বাসায় আমার ও নয়নের বিয়ে হয়। তারপর আমি বাসায় চলে যাই। বাসায় গিয়ে নয়নকে ফোন করে বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখতে বলি। তখন নয়ন বলে, ‘এটা বালামে ওঠে নাই, বালামে না উঠলে বিয়ে হয় না’।

এরপরও আমি নয়নের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখি। নয়নের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি আমার পরিবারের কেউ জানে না।

২০১৯ সালের শুরুর দিকে কলেজ থেকে পিকনিকে কুয়াকাটা যাওয়ার বাস আমি মিস করি। তখন নয়নের মোটরসাইকেলে আমি কুয়াকাটা যাই এবং নয়নের সঙ্গে একটি হোটেলে রাত্রিযাপন করি। আমি নয়নের বাসায় আসা-যাওয়াকালে ধীর ধীরে জানতে পারি নয়ন মাদকসেবী, ছিনতাই করে এবং তার নামে থানায় অনেক মামলা আছে।

এ কারণে নয়নের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি হয় এবং রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার পূর্বের ভালোবাসার সম্পর্ক আবার শুরু হয়।

গত ২৬/৪/১৯ তারিখ পারিবারিকভাবে রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়নের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ, শারীরিক সম্পর্ক, মোবাইলে কথাবার্তা, ম্যাসেজ, ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ সবই চলত।

বিয়ের পর জানতে পারি রিফাত শরীফ মাদকসেবী, সে মাদকসহ পুলিশের নিকট ধরা খায়। বিষয়টি জানতে পেরে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পরি। আমি রিফাতসহ আমার বাবার বাসায় থাকতাম। মাঝে মাঝে তাদের বাসায় যেতাম। নয়ন বন্ডের বিষয় নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা-কাটাকাটি হতো এবং রিফাত শরীফ আমার গায়ে হাত তুলত।

গত ২৪/৬/১৯ তারিখ দুপুর ১২.৩০টার দিকে নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দিয়ে বলে যে, ‘তোর স্বামী হেলালের ফোন ছিনাইয়া নিয়াছে’। পরে রিফাত ফরাজীও আমাকে ফোন দিয়ে বলে, হেলালের মোবাইলটি রিফাতের কাছ থেকে নিয়ে হেলালকে ফেরত দিতে। আমি রিফাত শরীফকে হেলালের ফোন ফেরত দিতে বললে রিফাত শরীফ আমাকে চড়-থাপ্পড় মারে এবং তলপেটে লাথি মারে।

রাতে মোবাইল ফোনে নয়নকে জানাই এবং কান্না করি। এরপর ২৫/৬/১৯ তারিখ আমি কলেজে গিয়ে নয়নের বাসায় যাই। রিফাত শরীফকে একটা শিক্ষা দিতে হবে- এ কথা নয়নকে বললে নয়ন বলে হেলালের ফোন নিয়ে যে ঘটনা তাতে রিফাত ফরাজীও তাকে মারবে। তারপর আমি বাসায় চলে আসি এবং রাতে এ বিষয়ে কয়েকবার আমার নয়ন বন্ডের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় এবং নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার স্বামী রিফাত শরীফকে মাইর দিয়া শিক্ষা দিতে হবে- এই পরিকল্পনা করি।

২৬/৬/১৯ তারিখ আমি কলেজে যাই এবং সায়েন্স বিল্ডিংয়ের পাশে বেঞ্চের ওপর রিফাত ফরাজী ও রাব্বি আকনকে বসা পাই। রিফাত হাওলাদার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন আমি রিফাত ফরাজীর পাশে বসি এবং রিফাত ফরাজীকে বলি ‘ওকি ভাইটু খালি হাতে আসছ কেন’?

এ কথার জবাবে রিফাত হাওলাদার বলে, ‘ওকে মারার জন্য খালি হাত যথেষ্ট’।

এরপর রিফাত ফরাজীকে জিজ্ঞাসা করি নয়ন বন্ড ও রিফাত শরীফ কলেজে এসেছে কি না। তখন নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দেয়। আমি সে কোথায় জানতে চাইলে নতুন ভবনের দিকে যেতে বলে এবং ওই সময় নয়ন বন্ড নতুন ভবনের পাশের দেয়াল টপকে ভেতরে আসে। আমি হেঁটে নতুন ভবনের দিকে যাই এবং নয়নের সঙ্গে রিফাত শরীফকে মারপিটের বিষয়ে কথা বলি।

এরপর রিফাত শরীফ কলেজের ভেতর আসে এবং আমাকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য কলেজ থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেল এর নিকট নিয়ে আসে। কিন্তু আমি মোটরসাইকেলে না উঠে সময়ক্ষেপণ করার জন্য পুনরায় কলেজ গেটে ফিরে আসি। রিফাত শরীফ আমার পেছন পেছন ফিরে আসে।

তখন রিশান ফরাজী কিছু পোলাপানসহ আসে এবং জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি আমার বাবা-মাকে গালি দিয়েছ কেন’? রিফাত শরীফ বলে, ‘আমি গালি দেই নাই’।

ওই সময় রিফাত ফরাজী জামার কলার ধরে এবং রিশান ফরাজী রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে। রিফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয়, রিশান ফরাজীসহ রিফাত হাওলাদার এবং আরো অনেকে রিফাত শরীফকে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে মারধর করতে করতে এবং টেনেহিঁচড়ে ক্যালিক্সের দিকে নিয়ে যায়।

ক্যালিক্সের সামনে তারা রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। আমি তখন সবার পেছনে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওই সময় নয়ন বন্ড ক্যালিক্সের সামনে এসে কিলঘুষি মারতে থাকে। মারপিটের মধ্যেই রিফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয় ও রিফাত হাওলাদার দৌড়ে যায় এবং রিফাত ফরাজী ২টি দা ও টিকটক হৃদয় এবং রিফাত হাওলাদার লাঠি নিয়ে আসে।

১টি দা দিয়ে নয়ন বন্ড ও ১টি দা দিয়ে রিফাত ফরাজী রিফাত শরীফকে কোপাইতে ছিল। রিশান ফরাজী রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখে যাতে রিফাত শরীফ পালাতে না পারে। রিফাত শরীফকে কোপাইতে দেখে আমি নয়ন বন্ডকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি। দায়ের কোপের আঘাতে রিফাত শরীফ রক্তাক্ত হয়। সে রক্তাক্ত অবস্থায় পূর্ব দিকে হেঁটে যায় এবং আমি রাস্তায় পরে থাকা জুতা পরি এবং উপস্থিত একজন আমার হাতে ব্যাগ তুলে দিলে আমি রিকশা করে ওকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি।

এরপর আমার বাবাকে ফোন করি। আমার বাবা ও চাচা হাসপাতালে আসে। এরপর রিফাত শরীফকে বরিশাল পাঠানো হয়। আমার কাপড়-চোপড়ে রক্ত লেগে থাকায় আমি বাসা চলে যাই। পরে আমি জানতে পারি রিফাতের অবস্থা খারাপ। তখন নয়নকে ফোন করে বলি তোমরা তাকে যেভাবে কোপাইছো তাতে তো ও মারা যাবে এবং তুমি আসামি হবা। তারপর ওর অবস্থা জানতে চাই এবং পালাতে বলি। দুপুরের পর খবর পাই রিফাত শরীফ মারা গেছে’’।

এই ঘটনায় মিন্নি স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর তাকে জেলহাজতে পাঠানো হলে মিন্নির পরিবার তার সঙ্গে দেখা করে এসে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন, তার মেয়েকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে জোর করে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তারা এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি মানেন না।

এরপর জবানবন্দি প্রত্যাহার চেয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতের বিচারকের বরাবর আবেদনও করেন মিন্নি।

সে সময় মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর এ জবানবন্দি গ্রহণের মাধ্যমে সত্যিকারের খুনিদের পুলিশ আড়ালের চেষ্টা করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

১৬ জুলাই সকাল পৌনে ১০টার দিকে মিন্নিকে তার বাবার বাড়ি বরগুনা পৌর শহরের নয়াকাটা-মাইঠা এলাকা থেকে পুলিশ লাইনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা হয়। এরপর দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে একই দিন রাত ৯টায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

পরদিন (১৭ জুলাই) মিন্নিকে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

১৯ জুলাই মিন্নি বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর কয়েক দফা আবেদন জানালেও নিম্ন আদালতে জামিন মেলেনি মিন্নির। পরে একই মামলায় জামিন চেয়ে মিন্নি হাইকোর্টে আবেদন করেন।

১ সেপ্টেম্বর রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয় পুলিশ। একই সঙ্গে রিফাত হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৫ জনকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।

গ্রেপ্তারদের মধ্যে ৬ কিশোর অপরাধী শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে রয়েছে। এ ছাড়া আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ জামিনে রয়েছেন ২ জন।

২৬ জুন সকাল সোয়া ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে রিফাত শরীফকে। তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি হামলাকারীদের সঙ্গে লড়াই করেও তাদের দমাতে পারেননি। গুরুতর আহত রিফাতকে ওই দিন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ ও পাঁচ-ছয় জনকে অজ্ঞাত আসামি করে বরগুনা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।