অন্ধ ও বধির হয়েও ১৩০টি দেশ ঘুরে ফেলেছেন তিনি

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১১:৩৯ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ৩০৬ বার।

অন্ধ ও বধির হয়েও ভ্রমণের নেশায় ঘুরে ফেলেছেন ১৩০টিরও বেশি দেশ। ঘুরেছেন বিশ্বের সব ক’টি মহাদেশ এমনকি অ্যান্টার্কটিকাও।

ব্রিটিশ নাগরিক ৪১ বছর বয়সী টনি জাইলসের এই ভ্রমণনেশার কথা উঠে এসেছে বিবিসির ট্রাভেল শো'তে।

বিবিসি বাংলা জানায়, জাইলস গত ২০ বছর ধরে নতুন নতুন জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছেন। জাইলসের ভ্রমণের অর্থ জোগাড় হয় তার প্রয়াত বাবার পেনশনের টাকা থেকে।                         

ইথিওপিয়া সফরের সময় এই ব্রিটিশ ভ্রমণপিপাসু বলেন, “আমি মানুষের কথা শুনি, পাহাড়ে উঠি, সবকিছু আমি আমার স্পর্শ এবং পায়ের মাধ্যমে অনুভব করি। ওভাবেই আমি একটি দেশ দেখি।”

 

এক ভ্রমণের সময় তিনি তার গ্রিক বান্ধবীর সঙ্গে পরিচিত হন যিনি নিজেও অন্ধ। গত বছর বান্ধবীর সঙ্গে রাশিয়া গিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বের বৃহত্তম দেশটির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ট্রেন দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন তারা। তবে অধিকাংশ ভ্রমণে জাইলস একাই ঘুরে বেড়িয়েছেন।

প্লেনের টিকিট কাটার ক্ষেত্রে তার মা তাকে সাহায্য করেন, তারণ জাইলসের মতে অধিকাংশ এয়ারলাইনস কোম্পানিতেই অন্ধদের জন্য যথেষ্ট সুবিধা নেই।

কোনো দেশে থাকার সময় যারা তাকে সাহায্য করেন, তাদের সঙ্গে আগেই বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ করে নেন তিনি।

জাইলস বলেন, “আমি কোনো বই বা ট্রাভেল গাইড দেখে ঠিক করতে পারি না যে একটি দেশের কোথায় কোথায় আমি যাব। ওই তথ্যগুলো ভ্রমণের আগেই জানতে হয় আমার। তাই আমি আগে থেকেই আমার সূচি ঠিক করে নেই।”

জাইলসের যখন নয় মাস বয়স, তখন তার চোখের সমস্যা প্রথম ধরা পড়ে। দশ বছর বয়সে তার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। এর আগে ছয় বছর বয়সে তিনি আংশিক বধির হিসেবে চিহ্নিত হন।

বর্তমানে কানে শোনার জন্য শক্তিশালী ডিজিটাল হিয়ারিং এইড ব্যবহার করলেও সব ধরনের শব্দ শুনতে পারেন না এই ব্রিটিশ নাগরিক।

 

তিনি একটি বিশেষ স্কুলে পড়ালেখা করেন এবং সেই স্কুল থেকেই ১৬ বছর বয়সে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ করেন।

এখনো মাঝেমধ্যে নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন জাইলস। ২০০৮ সালে এ কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে তার কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয়। বিভিন্ন বস্তু ছুঁয়ে অনুভব করতে পছন্দ করেন জাইলস।

১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারান জাইলস। ১৬ বছর বয়সে হারান তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে,  যিনিও শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন।

জাইলস বলেন, “ওই ঘটনার পরের ছয় থেকে সাত বছরের জন্য আমি মদে আসক্ত হয়ে পড়ি। ২৪ বছর বয়সের মধ্যে আমি পুরোপুরি অ্যালকোহলিক হয়ে যাই।”

জাইলসের বাবা সদাগরী জাহাজে কাজ করতেন। শিশু বয়সে বাবার কাছ থেকে শোনা দূরদেশের গল্প জাইলসের মধ্যে আলোড়ন তৈরি করে।

তিনি বলেন,  “যখন মদের নেশা থেকে আরোগ্য লাভ করি, তখন দেখতে পাই যে সম্পূর্ণ নতুন রাস্তায় জীবন চালানোর সুযোগ রয়েছে।”

 

২০০০ সালের মার্চে নিউ অরলিন্সে ভ্রমণের মাধ্যমে তার ব্যাকপ্যাকিং অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয়।

জাইলস বলেন, “আমি যানতাম না কোথায় যাচ্ছি। দারুণ চিন্তিত ছিলাম, সেসময় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে বলি: টনি, তুমি এই অ্যাডভেঞ্চার না চাইলে বাড়ি যাও।”

সেসময় তিনি পিছু না হটার সিদ্ধান্ত নেন এবং তারপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব ক’টি রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন।

জাইলস বলেন, “ভ্রমণ শুরু করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল নিজের আবেগ থেকে পালানো।”

নতুন নতুন জায়গায় ভ্রমণের ফলে তার মধ্যে অনেক ইতিবাচক চিন্তারও তৈরি হয়েছে।

এই ভ্রমণচারী বলেন, “মানুষের সঙ্গে মেশার পর আমি বুঝতে পারি, আমি অন্ধ বলে তারা আমার সঙ্গে মেশে না-মেশে আমার ব্যক্তিত্বের কারণে।”

জাইলস খুবই কম খরচের মধ্যে ঘোরাঘুরি সারেন। যে কোনো জায়গায় তিনি গণপরিবহন ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। থাকার ক্ষেত্রেও একদমই সাদামাটা আবাসস্থল পছন্দ করেন তিনি।

তিনি বলেন, “একদম সাদামাটা পরিবেশে থাকতে পছন্দ করি আমি - এর ফলে আমার সব ইন্দ্রিয় জাগ্রত থাকে।”

সবকিছু স্পর্শের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেন জাইলস। অনুভবের মাধ্যমে পরিচয় পেতে চান বিভিন্ন বস্তুর। কখনো কখনো স্থানীয় মানুষ ও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে গাইড ভাড়া করেন জাইলস

মানুষের সঙ্গে কথা বলে এবং অন্যদের কথা শুনে নিজের মনে সবকিছুর একটি চিত্র তৈরি করেন তিনি। যে কোনো জায়গায় সাধারণত দুর্গম পথ এড়িয়ে চলেন জাইলস। অধিকাংশ সময়ই নিজের জন্য আলাদাভাবে গাইড ভাড়া করেন তিনি।

ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় একটি শিল্পকলা জাদুঘরে সবকিছু ছুঁয়ে অনুভব করার অনুমতি দেওয়া হয় তাকে।

জাইলস বলেন, “এর ফলে তিনিও উপস্থিত সবার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেছেন। বিশ্বের অনেক জাদুঘরেই দর্শনার্থীদের এ রকম সুযোগ দেওয়া হয় না।”

 

অনেক সময় গাইড পান না তিনি। তবে হারিয়ে গেলেও আতঙ্কিত হন না জাইলস। অপেক্ষা করেন কোনো একজন পথিকের জন্য, যে তাকে সাহায্য করতে পারে।

তিনি বলেন, “বহুবার এমন হয়েছে যে, অপরিচিত মানুষ তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়ন করেছে। অনেক সময়ই অপরিচিত ব্যক্তিরা তার সফরে তাকে সাহায্য করেছে।”

বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় জাইলস সেসব অঞ্চলের বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পছন্দ করেন।

এই ব্রিটিশ নাগরিক বলেন, “সংগীত আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়গুলোর একটি। সংগীতের মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। সংগীত সব বাধা অতিক্রম করতে পারে।”

সব অঞ্চলের স্থানীয় খাবার খাওয়াও তার ভ্রমণের অন্যতম লক্ষ্য থাকে। জাইলস অনেক দর্শনীয় জায়গায় গিয়েছেন এবং অনেক জায়গার ছবিও তুলেছেন। সেসব ছবি জাইলস নিজে হয়তো উপভোগ করতে পারেন না, তবে তার ওয়েবসাইটগুলোতে দর্শকেরা সেসব ছবি দেখে বিশ্বের নানা জায়গা সম্পর্কে জানতে পারেন।

অনেক সময় মানুষ তার ভ্রমণের নেশা দেখে হতবাক হয়ে যায়। তারা জিজ্ঞেস করে, “একজন অন্ধ ব্যক্তি কেন পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাইবে?” জাইলসের উত্তরটা কিন্তু খুবই সহজ,  “কেন নয়?”

তিনি বলেন, “আমার লক্ষ্য হলো বিশ্বের সব ক’টা দেশ ভ্রমণ করা। মানুষকে আমি দেখাতে চাই যে, আপনি বিকল্প পন্থায়ও বিশ্বকে দেখতে পারেন।”