দুদকের তৎপরতায় ৯জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ: মামলা হচ্ছে

বগুড়ায় হোল্ডিং ট্যাক্সের ৯০ লাখ টাকা পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে

পুণ্ড্রকথা রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৯ ০৫:৫৭ ।
প্রচ্ছদ
পঠিত হয়েছে ১৫০১ বার।

বগুড়া শহরের বসত-বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে ট্যাক্স হিসেবে আদায় করা অন্তত ৯০ লাখ টাকা পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুয়া রশিদ বই ছাপিয়ে এবং রশিদ বইয়ের কার্বন কপি জালিয়াতি করে বগুড়া পৌরসভা কার্যালয়ে বসেই বছরের পর বছর ধরে ওই অপকর্ম করা হলেও তা কর্তৃপক্ষের নজরে আসনি। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর পরই পৌরসভা প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।
দুদকের তৎপরতার মুখে ট্যাক্সের টাকা আত্মসাতের ওই ঘটনায় বগুড়া পৌরসভার তৎকালীন এক সচিবকে বদলী, কর বিভাগের ২ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং চুক্তিভিত্তিক অপর ৬ কর্মচারিকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দুদকের পক্ষ থেকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের প্রস্তুতির পাশাপাশি পৌরসভার কর বিভাগের ৩ কর্মকর্তার সম্পদের অনুসন্ধানও শুরু করেছে। এসব তৎপরতার মুখে অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে আত্মসাৎ করা ৬৭ লাখ টাকা ফেরতও দেওয়া হয়েছে।
দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৪ সাল থেকে ওই অপকর্ম চলেছে। আর পৌরসভার কর্মকর্তারা বলছেন ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে পরবর্তী দুই বছর ট্যাক্সের টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। দুদকের প্রাথমিক তদন্তে ট্যাক্স আত্মসাতের ঘটনায় ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা মিলেছে। তবে পৌরসভার পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ৯ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বগুড়া পৌরসভার তৎকালীন সচিব ইমরোজ মুজিবকে জেলার শেরপুর পৌরসভায় বদলী করা হয়েছে। এছাড়া পৌরসভার বাজার আদায়কারি একেএম আকিল আহম্মেদ মোমিন ও সহকারি কর নির্ধারক রায়হানুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। 
ওই ঘটনায় কর বিভাগে চুক্তি ভিত্তিতে কর্মরত আলমগীর রহমান, মশিউর রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন, বেলাল হোসেন, সাখাওয়াত হোসেন ও মাসুদ সরকার কনক নামে ৬ জনকে  চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে পৌরসভার পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও সংস্থাটির কর বিভাগের আরও ৬ কর্মকর্তা শফিউল আলম, জামিল মজুমদার, জাহাঙ্গীর আলম, আলমগীর রহমান, হেফজুল বারী ও সারওয়ার জাহানের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও দুদকের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। 
প্রায় দেড়শ’ বছর প্রাচীন বগুড়া পৌরসভার ২১ ওয়ার্ডে সরকারি-বেসরকারি মিলে ৬৫ হাজার ৩৮৩টি হোল্ডিং রয়েছে। এর মধ্যে পুরানো ১২টি ওয়ার্ডে হোল্ডিংয়ের সংখ্যা ৩০ হাজার ৫৭১টি। বাকি ৩৪ হাজার হোল্ডিং রয়েছে ২০০৬ সালে সম্প্রসারিত ৯টি ওয়ার্ডে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একজন বসত-বাড়ির মালিককে ৪টি খাতে পৌরসভায় ট্যাক্স দিতে হয়। এগুলো হলো- হোল্ডিং (বসত বাড়ি অথবা ফাঁকা জায়গা), কঞ্জারভেন্সি, লাইটিং (সড়ক বাতি) ও পাইপ লাইনে পানি সরবরাহ। 
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাগরিকদের কাছ থেকে আদায় করা ট্যাক্স আত্মসাতের কথা জানিয়ে বেনামে একটি লিখিত অভিযোগ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে দুদক কার্যালয়ে পাঠানো হয়। এরপর দুদকের পক্ষ থেকে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু হলে ভয়াবহ ওই অপকর্মের বিষয়টি পৌরসভা কর্তৃপক্ষ অবহিত হন। একই বছরের মার্চে দুদক আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে। তার পর পৌরসভার পক্ষ থেকেও তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একাধিক সূত্র জানায়, প্রথমে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য পৌরসভার তৎকালীন সচিব ইমরোজ মুজিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি দুর্নীতিবাজদের ধরার পরিবর্তে  ওই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ওই ঘটনায় গেল বছররের ১৮ জুন মেয়রের নির্দেশে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। 
পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ২৮ জুন অনুষ্ঠিত পৌরসভার ২১তম সাধারণ সভায় সচিব ইমরোজ মুজিবকে অভিযুক্ত করে রেজুলেশন গ্রহণ করা হয়। তাতে বলা হয় সচিব ইমরোজ মুজিব কর আদায় শাখার কতিপয় কর আদায়কারীর সাথে যোগসাজশে পৌর করের আদায়কৃত টাকা আত্মসাত করেছেন। তিনি ঢাকা থেকে কর আদায়ের ডুপ্লিকেট রশিদ ছাপিয়েছেন। রেজুলেশন গ্রহণের প্রায় এক মাস পর ৫ আগস্ট তাকে জেলার শেরপুর পৌরসভায় বদলীয় করা হয়। তারও তিন মাস পর ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর কর বিভাগের দুই কর্মকর্তা একেএম আকিল আহম্মেদ মোমিন ও রায়হানুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত এবং চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োজিত অপর ৬ কর্মচারীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের পর মামলা থেকে রেহায় পেতে আত্মসাতের ঘটনায় জড়িতদের কেউ কেউ তাদের আত্মসাৎ করা টাকা জমা দিতে শুরু করেছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভিযুক্ত ১৫ জনের পক্ষ থেকে ৬৭ লাখ ৮১হাজার ৪৫৭ টাকা জমা অর্থাৎ ফেরত দেওয়া হয়েছে।
 তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিযুক্তরা দুইভাবে ট্যাক্সের টাকা আত্মসাত করেছেন। প্রথমত তারা রশিদ বইয়ের গ্রাহকের কপিতে জমা করা টাকার পরিমাণ সঠিক লিখলেও নিচের কার্বণ কপিতে কম লিখতেন এবং দ্বিতীয়ত ভুয়া জমা বই ছাপিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা পুরো টাকাই আত্মসাত করতেন। এভাবে আত্মসাত করা টাকা অভিযুক্তরা নির্ধারিত পার্সেন্টেজে ভাগ করে নিতেন। অনুসন্ধানকালে তাদের অর্থ ভাগাভাগির একটি নথি  এ প্রতিবেদকের হাতে
 এসেছে। কম্পিউারে তৈরি ওই সিটে ট্যাক্স হিসেবে আদায় করা টাকার মধ্যে পৌরসভার সচিব থেকে কর বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কে কত পার্সেন্ট পকেটে তুলবেন তার উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে সবচেয়ে বেশি ৩৫ পার্সেন্ট সচিবকে দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। ওই নথিতে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর (১৩৭৭০ ও ৩৪১২৬ নং সিটে) ট্যাক্স হিসেবে আদায় করা ৪৭ হাজার ৮৯৬ টাকার মধ্যে পৌরসভায় জমা করা হয়েছে ৫৬ দশমিক ২১ শতাংশ বা ২৬ হাজার ৯২৬ টাকা। বাদবাকি ২০ হাজার ৯৫১ টাকা নিজেরা আত্মসাত করেছেন।
বগুড়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র শামছুদ্দিন শেখ হেলাল জানান, কর শাখায় যে দুর্নীতি হচ্ছে সেটা প্রথম দিকে তারা বুঝতে পারেন নি। তবে একদিন এক দুর্নীতিবাজ কর্মচারী বাসায় গিয়ে তাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে চাইলে তার সন্দেহ হয়। তিনি বলেন, ‘কর বিভাগের একজন কর্মচারী কেন আমাকে এতগুলো টাকা দিতে এসেছে। সে এই টাকা পেল কোথায়। ওই চিন্তা-ভাবনা থেকেই আমি অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম তারা দীর্ঘদিন ধরে জনগণের ট্যাক্সের টাকা আত্মসাত করে আসছে।’ ওই ঘটনায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের পর ট্যাক্স আদায় কয়েকগুণ বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আর যাতে কোন দুর্নীতি না হয় সেজন্য আমরা পৌরসভায় ব্যাংকের বুথ স্থাপন করে তাতে ট্যাক্সের টাকা জমার ব্যবস্থা করেছি। এতে আগের তুলনায় ট্যাক্স আদায়ের হারও কয়েকগুণ বেড়েছে।’
দুদক বগুড়া জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক আমিনুল ইসলাম জানান, প্রাথমিক তদন্ত ৯০ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মামলার জন্য সবকিছু চুড়ান্ত করছি।’ অপর সহকারি পরিচালক রবীন্দ্রনাথ চাকী বলেন, ‘পৌরসভার কর বিভাগের তিন কর্মকর্তার সম্পদের অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তাদের তলবও করা হয়েছিল।’
বগুড়া পৌরসভার মেয়র অ্যাডভোকেট একেএম মাহবুবর রহমান জানান, ট্যাক্সের টাকা আত্মসাতের ওই ঘটনা বিলম্বে জানতে পারলেও প্রাথমিক তদন্তে জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালকের দফতর এবং দুদকও পৃথকভাবে তদন্ত করছে। জড়িদের কাউকে ছাড়া হবে না।
তবে যোগাযোগ করা হলে বগুড়া পৌরসভার তৎকালীন সচিব ইমরোজ মুজিব ট্যাক্সের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি দুর্নীতি বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলাম বলেই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা হয়েছে। আমি যে নির্দোষ তার সকল প্রমাণ আমার কাছে আছে।’ আর সাময়িক বরখাস্ত হওয়া বগুড়া পৌরসভার বাজার আদায়কারি একেএম আকিল আহম্মেদ মোমিনের সঙ্গে টেলিফোনে যেগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি টেলিফোনে কোন কথা বলবো না, সাক্ষাতে কথা বলবো।’