বগুড়ার উপ-নির্বাচন

‘সেলিব্রেটি’ হিরো আলমের প্রচারে এক ঝাঁক ইউটিউবার

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারী ২০২৩ ১০:১২ ।
দেশের খবর
পঠিত হয়েছে ২৪ বার।

বগুড়ায় সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রায় সব প্রার্থী তাদের সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে নামলেও কেবল ব্যতিক্রম সামাজিযোগ যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। জেলার দু’টি আসন থেকে প্রতিদ্ব›দ্বীতায় অবতীর্ণ হিরো আলমের সঙ্গে সমর্থকদের পরিবর্তে রয়েছেন একঝাঁক ইউটিউবার। 

 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিরো আলমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকা ১০জন ইউটিবারের মধ্যে ৭জনই ঢাকা থেকে এসেছেন। তাদেরকে রাখা হয়েছে হিরো আলমের বাড়ি বগুড়া সদরের এরুলিয়া এলাকার আবাসিক হোটেলে। বাকি ৩জনের একজন হিরো আলমের ইউটিউব চ্যানেল ‘হিরো আলম অফিসিয়াল’-এর কর্মী। অন্য দু’জন স্থানীয় ইউটিবার। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে গভীর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা হিরো আলমকে ফলো করছেন। তবে দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, জাতীয় এবং স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকরাও ভিডিও ক্যামেরা নয়তো মোবাইল ফোন নিয়ে ছুটছেন হিরো আলমের পিছনে। 

 


সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র দাখিলের পর থেকেই সাংবাদিক ও ইউটিউবাররা হিরো আলমকে অনুসরণ করছেন। সাংবাদিকদের তৎপরতা হিরো আলমের নির্বাচনী গণসংযোগের চিত্রধারণ এবং তাঁর প্রতিক্রিয়া গ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। তবে নিজেদের ধারণ করা ভিডিওতে বেশি ভিউ এবং লাইক পাওয়ার আশায় ইউটিউবাররা হিরো আলমকে নিয়ে মাতামাতি করছেন। হিরো আলম গ্রামের কোন সড়ক দিয়ে হেঁটে যেতেন, তার বাড়ি দেখতে কেমন, তিনি কোন ঘরে ঘুমাতেন- সেগুলোর বর্ণনা সম্বলিত ভিডিও ধারণ করে সেগুলো কে কার আগে আপলোড করবেন সেটা নিয়ে যেন তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এমনকি সড়কের পাশে একটি ছাউনি ঘেরা দোকানে বসে শুধু ভর্তা আর বেগুন ভাজি দিয়ে তার ভাত খাওয়ার দৃশ্যও প্রচার করতে দেখা গেছে। ওদিকে প্রায় সারক্ষণ ইউটিউবার এবং সাংবাদিক পরিবেষ্টিত থাকতে দেখে নিজ এলাকার লোকজন বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষের কাছে হিরো আলম সেলিব্রেটির মর্যাদা পেয়েছেন।

 


বগুড়া সদর উপজেলার এরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা হিরো আলম এক সময় কেবল  নেটওয়ার্কের ব্যবসা (ডিশ সংযোগ প্রদান) করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ২০০৮ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি মডেলিংয়ে যুক্ত হন। এরপর নিজের অভিনয় ও গানের দৃশ্য রেকর্ড করে ক্যাবল নেটওয়ার্কে প্রচার করতে শুরু করেন। এতে নিজ এলাকায় তার জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। সেটাকে পুঁজি করে তিনি পরবর্তীতে এরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে পর পর দুইবার প্রতিদ্ব›দ্বীতা করে পরাজিত হন। এরপর ২০১৬ সালে তিনি ‘হিরো আলম’ নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পেজ খুলে তাতে অভিনয় ও গানের দৃশ্যগুলো ছড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে তিনি ইউটিউবেও সরব হন। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা হিরো আলম ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৪ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেন। তবে তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন এবং সিংহ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করেন।  ওই নিবাচনে তিনি ৬৩৮ ভোট পান।

 


সরকার বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে বগুড়া-৪ (কাহালু ও নন্দীগ্রাম) এবং বগুড়া-৬ (সদর) আসনের বিএনপি দলীয় দুই সংসদ সদস্য গত ১১ ডিসেম্বর করলে হিরো আলম ওই দুটি আসনে প্রতিদ্ব›দ্বীতার কথা ঘোষণা করেন। সেই অনুযায়ী গত ৫ জানুয়ারি তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে মনোনয়ন পত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আসনের মোট ভোটারের এক শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক সমর্থনে স্বাক্ষরের ত্রæটি থাকায় ৮ জানুয়ারি তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।  পরে হিরো আলম উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৭ জানুয়ারি প্রার্থীতা ফিরে পান এবং পরদিন রিটার্নিং অফিসারের কাছ থেকে তার পছন্দের একতারা প্রতীক বরাদ্দ নেন।

 


নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে দেখা যায় মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে হিরো আলম কোটিপতি হয়েছেন। ২০১৮ সালে তিনি ২১ শতাংশ কৃষি জমি থেকে বছরে ৬ হাজার টাকা এবং অভিনয় থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় করতেন। তখন তার পুরানো একটি মোটর সাইকেল ছিল। আর বর্তমানে ৯ শতাংশ জায়গার ওপর তার বাড়ি নির্মাণ করেছেন এবং কিনেছেন প্রাইভেট কারও। এছাড়া ৫৫ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র ছাড়াও কৃষি জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ এবং স্ত্রীর স্বর্ণালংকার ১ ভরি থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ ভরি।

 


গত ২৫ জানুয়ারি বুধবার সকালে শহরের গোদারপাড়া এবং চারমাথা এলাকায় গণসংযোগের সময় হিরো আলমের সঙ্গে সাংবাদিক এবং ইউটিবারসহ ১৫জনকে ক্যামেরা এবং মোবাইল ফোন নিয়ে হাজির থাকতে দেখা গেছে। ঢাকা থেকে যেসব ইউটিবার এসেছেন তারা হলেনঃ এমদাদ সরকার, রাহিদ রনি, আরমান হোসেন, মোস্তাফিজার রহমান, ইমন সাদিক আকাশ এবং মুজাহিদুর রহমান। হিরো আলমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকার কারণ জানতে চাইলে নিউজ এবিসি নামে একটি অনলাইন পোর্টালের মুজাহিদুর রহমান বলেন, ‘আমি বিনোদন নিয়ে কাজ করি। হিরো আলম বিনোদন জগতের মানুষ। বছরের অন্য সময় যখনই প্রয়োজন হয় তখন তার নিউজ কভার করতে হয়। সে এখন ভোট করছে তাই বগুড়ায় এসে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউটিউবার বলেন, ‘হিরো আলমের অনেক লাখ লাখ ভক্ত আছে। তার ভিডিও ইউটিউবে ছাড়লে অনেকে সেটা দেখেন। তাতে আমার ইউটিউব চ্যানেলের ভিউ এবং সাবস্ক্রাইবার দুটোই বাড়ে। বলতে পারেন ব্যবসার জন্যই এসেছি।’

 


বগুড়ার এরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সোবহান হিরো আলমকে তাদের গর্ব উল্লেখ করে বলেন, ‘তাঁই (তিনি) একন (এখন) অনেক বড় হচে (সেলিব্রেটি) দেকেই (বলেই) রাত-দিন অনেক সংবাদিক তার পেছন পেছন ঘোরে।’ আব্দুল লতিফ নামে অপর একজনের ধারণা এলাকর ভোটারদের অধিকাংশ ভোটারই এবার হিরো আলমের প্রতীক এক তারায় ভোট দিবেন। 

 


নির্বাচনী প্রচারে সার্বক্ষণিক এক ঝাঁক ইউটিউবারের উপস্থিতি প্রসঙ্গে হিরো আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘তারা (ইউটিউবার) আমাকে ভালবাসেন। তারা আমার সঙ্গে থাকতে চেয়েছেন। আমি তো তাদের নিষেধ করতে পারি না।’

 


বগুড়ায় তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা তরুণ উদ্যোক্তা এস এম কে আবেদীন সনি জানান, হিরো আলমের কর্মকাণ্ড হয়তো অনেকেরই পছন্দ নয়। কিন্তু এটা সত্য সাধারণ মানুষে কাছে তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি যারা শ্রমিক শ্রেণির মানুষ তারা সারাদিনের পরিশ্রমের পর বিনোদনের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিরো আলমকে খোঁজেন। এটা শুধু দেশেই নয় বিদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত আমাদের প্রবাসীরাও দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হিরো আলমকে খোঁজেন। যেহেতু ফেসবুক এবং ইউটিউবে তার লাখ লাখ ভক্ত তৈরি হয়েছে সে কারণে আমাদের তরুণ ইউটিউবারদের অনেকে বেশি ভিউ এবং লাইক পাওয়ার জন্যই তার পেছনে ছুটছেন।

 


সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক জানান, হিরো আলমের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত নির্বাচন আচরণবিধি লংঘনের কোন অভিযোগ ওঠেনি। এছাড়া সাধারণ জনগণও তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ করেনি। সে কারণে এটা বলা যায় যে, হিরো আলমের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ বেশ উপভোগই করছেন। তবে তিনি বলেন, মানুষকে বিনোদিত করা, আনন্দ দেওয়া আর ভোটার হিসেবে সমর্থন পাওয়া দুটো এক জিনিস নয়।