তালপাতার হাতপাখায় তাদের জীবনগাঁথা

মুনসুর রহমান তানসেন, কাহালু (বগুড়া) থেকেঃ
প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২৪ ১৭:৩৭ ।
বগুড়ার খবর
পঠিত হয়েছে ৩৭ বার।

গ্রামীণ জনপদের একটি অতি পরিচিত নাম ঐতিহ্যবাহী তালপাতা দিয়ে তৈরি হাতপাখা। এই তালপাতার পাখায় আবার-বৃদ্ধ-বণিতার নিখুঁত হাতের নকশায় ফুটে উঠে গ্রামবাংলার লোকগাঁথা জ্যামিতিক নকশা। প্রচলিত প্রবাদ বাক্য ”শীতের কাঁথা, বর্ষার ছাতা আর গরমে পাখা” এ ছিল বাঙালির চিরকালের সম্বল।

পাখা তৈরি ও ব্যবহারের ইতিহাস বহু প্রাচীন। তালপাতার পাখা ব্যবহারের ইতিহাস বহু প্রাচীন হলেও এখনো গ্রাম বাংলার মানুষ গরমে শীতল বাতাস পাওয়ার অবলম্বন বলতে বোঝে তালপাতার তৈরি হাতপাখা। চৈত্রের প্রখর রৌদ্র আর জৈষ্ঠের আম-কাঠাল পাকা গরম অথবা ভাদ্রের কাঠফাটা তাপদাহ আবহমান বাংলার চির পরিচিত। পীড়াদায়ক গরম থেকে স্বস্তির হাতিয়ার এই তালপাতার হাতপাখা।

যান্ত্রিক সভ্যতায় বাঙালির লোকগাঁথা অনেক শিল্পের মতো দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক তালপাতার তৈরি হাতপাখা বিলুপ্তির পথে। এখন সবখানেই ব্যবহার হচ্ছে বৈদ্যুতিক পাখা। ধনীদের ঘরে চলে এসি। বিদ্যুতবিহীন অবস্থায় কোথাও কোথাও চোখে পড়ে প্লাষ্টিকের হাতপাখা। তারপরেও তালপাতার পাখায় যাদের জীবনগাঁথা তারা এখনো টিকে রেখেছেন বাপ-দাদার এই আদিপেশা তালপাতার পাখা তৈরির কাজ।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের আড়োলা, আতালপাড়া ও যোগীরভবন এলাকার প্রায় ৩০০ পরিবার এখনো তালপাতার পাখা তৈরি করেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন। গরম পরার আগে থেকেই তারা শুরু করেন পাখা তৈরির কাজ। পাখা তৈরির জন্য তারা কার্তিক মাস থেকে সংগ্রহ করতে থাকেন  তালপাতা, বাঁশ, পাাখা তৈরির জিনিসপত্র। কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাস ধরে তারা পাখা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুদ করে মাঘ মাস থেকে পাখা তৈরির কাজে হাত দেন। তাদের এই কাজ চলে ভাদ্র মাস পর্যন্ত। 
   আড়োলা উত্তরপাড়ার বৃদ্ধ মজিবরের বয়স এখন ৮৪ বছর। বয়েসের ভারে নুয়ে পড়লেও এখনো তিনি স্ত্রী মনোয়ারা (৭৮) কে নিয়ে পাখা তৈরি করছেন। পাইকড় ইউনিয়নের এই পাখার গ্রামগুলো ঘুরে লক্ষ্য করা গেছে পাখা তৈরির জন্য একেক জন একেক কাজ করছেন। কেউ তালপাতা কেটে নিচ্ছেন, কেউ চাক বাঁধছেন। কেউ রং তুলি দিয়ে পাখায় নকশা করছেন আবার কেউ পাখার ডাটি লাগাচ্ছেন। এভাবেই প্রতিটি ঘরে ঘরে ও বাড়ির উঠানে চলছে পাখা তৈরির কাজ।

সেখানকার পাখাশিল্পী নুরজাহান জানালেন তারা প্রথমে তালপাতা কেটে নিয়ে তা রোদে শুকিয়ে নেন। তারপর পাখা তৈরির ডিজাইনে আবার তালপাতা কেটে নিয়ে বাঁশের পাতি দিয়ে বেঁধে হলুদ রং এ ভিজিয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে শুকিয়ে নেওয়ার পর পাখার চতুর ধার সুতো দিয়ে বেঁধে বিভিন্ন রং দিয়ে তুলির আঁচড়ে নকশা করা হয়। তারমতে যোগীরভবন, আড়োলা ও আতালপাড়ায় প্রকারভেদে চার  ধরণের পাখা তৈরি করা হয়। তাদের তৈরি পাখার মধ্যে রয়েছে ডাটি পাখা, হরতন পাখা,  ঘুরকি পাখা ও পকেট পাখা। এই পাখাগুলো প্রকারভেদে পাইকারী দরে প্রতি পিচ ১৫ টাকা থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়।

৭৫ বছরের বৃদ্ধ  ধলু পাইকার জানান, তিনি চাক তোলেন ও পাখার ডাট তৈরি করেন। ১০০ চাকের মজুরী ১০০ টাকা ও ১০০ পাখার ডাট তৈরির মজুরী ৫৫ টাকা পান। ধলু মিয়ার স্ত্রী ১০০ পাখায় নকশা করে ১০০ টাকা পান। ধলু পাইকারের মতে তাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষই পাখা তৈরি করে সংসার চালান। পাখাশিল্পী আঃ রাজ্জাক জানান, তিনি নগরবাড়ির এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০ হাজার পাখা তৈরির অর্ডার পেয়েছেন,  আরও অনেক ব্যবসায়ী অর্ডার দিতে চাচ্ছেন। যারফলে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে নিজেই পাখা তৈরি করছেন এবং স্থানীয় তৈরিকারকদের কাছ থেকে পাখা সংগ্রহ করছেন।

টুকু মিয়া ও তার স্ত্রী ফাইমা প্রায় ১ মাস আগে পাখা তৈরির আগাম অর্ডার নেন। বর্তমানে ঘুরকি পাখার বাজার ১৫/১৬ টাকা হলেও আগাম অর্ডারের টাকা নেওয়ায় তাকে সেই পাখা ১৩ টাকা পিচ দরে দিতে হচ্ছে। এই দম্পতি জানান, সরকারিভাবে এই শিল্পের জন্য পৃষ্টপোষকতা করলে এখানে তৈরি পাখা সারাদেশে সরবরাহ করা সম্ভব। পাখার গ্রামের গৃহবধু শ্যামলী, জাকিয়াসহ অনেকে জানালেন আমাদের এখানকার কয়েকটি পাড়ার মানুষই পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা এখানে বধু হয়ে আসার পর থেকেই শুনছেন এই গ্রামের সকল মানুষের জীবনের সাথে গাঁথা রয়েছে তালপাতার পাখা তৈরির কাজ।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মিটু চৌধুরী জানান, এই হস্তশিল্প বাঁচিয়ে রাখতে পাখা তৈরিকারকদের আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকি।