কৃষককে বশে আনতে না পারার কারণেই তৈরি হয় ‘কাগুজে হিসাব’?

আলু উৎপাদনে প্রকৃত খরচ জেনেও আমলে নেয় না কৃষি বিভাগঃ বিপাকে চাষীরা

বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৪ ২৪:০১ ।
দেশের খবর
পঠিত হয়েছে ২০ বার।

রোগ বালাইয়ের কারণে বগুড়ায় এবার প্রতি বিঘা জমিতে (৩৩ শতক বা শতাংশ জমি) আলুর ফলন গড়ে ৩০ শতাংশ কমেছে। আর অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, সার, বীজ, সেচ এবং শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির কারণে সার্বিকভাবে এবার আলুর উৎপাদন ব্যয়ও গড়ে প্রায় ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর এক কেজি আলুর উপৎপাদন খরচ ছিল ১০ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু এবার একই পরিমাণ আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ১৮ টাকা ৫৭ পয়সা। সম্প্রতি বগুড়ার ৪টি উপজেলায় অন্তত ১০জন আলু চাষীর সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জেলা কৃষি বিভাগও আলুর উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছে। তবে তাদের হিসাবে মূল্য বৃদ্ধির হার মাত্র ৪৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। কৃষি বিভাগের দেখানো হিসাবে গত বছর এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ছিল ৯ টাকা ৬৯ পয়সা আর এবার তা ১৪ টাকা ২ পয়সা। তাদের দেখানো এই হিসাব কৃষকদের রীতিমত বিস্মিত করেছে। এমনকি কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যয়ের কর্মকর্তারাও দ্বিমত পোষণ করেছেন। জেলায় মোট আলুর এক তৃতীয়াংশ আবাদ হয় যে এলাকায় সেই শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী এবার এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ২২ টাকা ১৯ পয়সা। কিন্তু তাদের এই হিসাব মন্ত্রণালয় নিতে চায়নি।


মাঠ পর্যায়ের একাধিক কৃষি কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানিয়েছেন, আলু আবাদে জেলা কৃষি বিভাগের দেখানো হিসাবের চেয়ে কৃষক ক্ষেত্র বিশেষে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি সার ব্যবহার করে থাকেন। এমনকি ডাই অ্যামোানিয়াম ফসফেট বা ড্যাপ সার কৃষক ব্যবহার করলেও তা উৎপাদন খরচের হিসাবে দেখানো যায় না। এর পাশাপাশি এবার বৈরি আবহাওয়ার কারণে কীটনাশকের ব্যবহারও বেশি করতে হয়েছে। কমেছে ফলনও। এসব কারণে গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি কেজিতে আলুর উৎপাদন খরচ বেশ বেড়েছে। তারা বলেন, ‘আমরা প্রকৃত উৎপাদন খরচ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে দাখিল করলেও “মন্ত্রণালয় মানবে না”- এমন অজুহাতে আমাদের তৈরি করা প্রকৃত হিসাব উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ আমলে নেন নি।’

 


আর কৃষকরা জেলা কৃষি দপ্তরের দেখানো আলুর উৎপাদন খরচের হিসাবকে ‘কাগুজে’ উল্লেখ করেছেন। এর প্রমাণ দিতে গিয়ে তারা বলছেন, অন্য রাসায়নিক সারের পাশাপাশি তারা ড্যাপ সারও ব্যবহার করেন। প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ৩৫ কেজি সার ব্যবহার করা হয়। যার দাম প্রায় সাড়ে ৯০০ টাকা। কিন্তু কৃষি বিভাগের উৎপাদন খরচের হিসাবের তালিকায় ড্যাপ সারের কোন নামই খুঁজে পাবেন না। এ থেকেই বোঝা যায় যে কৃষি বিভাগের হিসাব পুরোপুরি অবাস্তব। কৃষকদের অভিযোগ, এবার আলু আবাদে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু কৃষি বিভাগ তা স্বীকার করতে চায় না। সে কারণে তাদের ক্ষয়-ক্ষতি আড়াল করতেই কৃষি বিভাগ কাল্পনিক হিসাব তৈরি করেছে।

 


সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, বিভিন্ন ফসলের জন্য প্রতি শতাংশ জমিতে রাসায়নিক ও জৈব সার প্রয়োগের জন্য কৃষি বিভাগের একটি নীতিমালা রয়েছে। রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা রয়েছে কীটনাশকের প্রয়োগেরও। কিন্তু কৃষি বিভাগ এগুলো কৃষকদের অনুসরণ করাতে পারেন নি। কিন্তু তারা তাদের এই ব্যর্থতা স্বীকার করতে চান না। সে কারণে তারা কৃষকদের কাছ থেকে প্রকৃত খরচের হিসাব না নিয়ে বরং নিজেদের মত করে উৎপাদন দেখাচ্ছে। আর এতেই দুই পক্ষের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ^াস বাড়ছে। এতে করে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়েও জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

 


বগুড়ায় মোট ২ লাখ ২৪ হাজার ৮৪৫ হেক্টর আবাদি জমির ২৪.৫৭ শতাংশ বা ৫৫ হাজার ২৬০ হেক্টরে আলুর আবাদ করা হয়। কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় এবং উচ্চ ফলনশীল মিলে মোট ৪৮ জাতের আলুর আবাদ হয় বগুড়ায়। এর মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি ১৭ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে এস্টারিক্স (স্থানীয়ভাবে স্টিক নামে পরিচিত) নামে উচ্চ ফলনশীল জাতের আলুর আবাদ হয়েছে। আর জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৮ হাজার ৫০০ হেক্টর বা এক তৃতীয়াংশ জমিতে আলুর আবাদ হয় জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা এলাকায়। কৃষি বিভাগের হিসাবে শুধু বগুড়া জেলাতেই নয় বরং সারা দেশের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি আলুর আবাদ হয় শিবগঞ্জে। 

 


সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝিতে আমন ধান কাটার পর আলুর চাষ শুরু হয়। ফেব্রæয়ারির মাঝামাঝি থেকে আলু উত্তোলন শুরু হয়। তবে কোন কোন এলাকায় অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আগাম জাতের আলু আবাদ করা হয়। যা জানুয়ারির মাঝামাঝিতে উত্তোলন করা হয়। আগাম জাতের ওই আলুর দামও স্বাভাবিক সময়ে উত্তোলন করা আলুর দেড় থেকে দুইগুণ পর্যন্ত বেশি হয়।

 

বৈরি আবহাওয়ায় ফলন কমেছে ৩০ শতাংশ
চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে ঘন কুয়াশা দেখা দেয়। যা জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৩ সপ্তাহ অব্যাহত ছিল। কুয়াশার কারণে আলুর গাছগুলো লেটব্রাইট রোগে আক্রান্ত হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত আলুর গাছ বাঁচাতে ঘন ঘন কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়েছে। এভাবে শেষ পর্যন্ত ফসল কোন রকমে রক্ষা করা গেলেও আলুর ফলন কমে যায়। শিবগঞ্জ উপজেলার চালুঞ্জা গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ জানান, এবার তাকে পর পর ৭ বার কীটনাশক ছিটাতে হয়েছে। কেউ কেউ ৯বার পর্যন্তও কীটনাশক ছিটিয়েছেন। অথচ গত বছর মাত্র দু’বার কীটনাশক দিতে হয়েছিল। অতিরিক্ত কীটনাশকের এজন্য এবার তাকে বাড়তি ৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। পাশের ভালুকখালি গ্রামের আলু চাষী ফজলুল হক জানান, এবার পোকার আক্রমণের কারণে আলুর ফলন অনেক কমেছে। গত বছর এক বিঘা (৩৩ শতাংশ জমি) জমিতে সাদা জাতের (প্রকৃত নাম সানসাইন) আলু লাগিয় তিনি ১০০ মণ ফলন পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার সেই একই জমিতে আলু পেয়েছেন মাত্র ৭০ মণ। তিনি বলেন, ‘যারা সময়মত কীটনাশক দিতে পারেন নি তাদের ফলন আরও কমেছে।’

 


আলু চাষীদের বর্ণনার মিল পাওয়া গেল শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা পলাশ কুমার সরকারের কথায়ও। তিনি বলেন, এবার রোগ বালাই বেশি হয়েছে। গত চারটি মৌসুমে এমনটা দেখা যায়নি। ইতিপূর্বে আলুর খেতে ৩/৪বার কীটনাশক স্প্রে করলেই হতো। কিন্তু এবার প্রতি সপ্তাহে দু’বার করে ৭ থেকে ৯ বার পর্যন্ত কীটনাশক স্প্রে করতে হয়েছে। এতে আলুর ফলনও গড়ে ৩০ শতাংশ কমেছে।

 


উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৭৭ শতাংশ
মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার ফলন বিপর্যায়ের পাশাপাশি কীটনাশক খাতে বাড়তি ব্যয়, সার, বীজ ও সেচের মূল্য বৃদ্ধি এবং শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির কারণে আলুর উৎপাদন খরচও বেড়েছে। গত বছর এক বিঘা জমিতে আলু উৎপাদনে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর সঙ্গে জমি ভাড়া ৭ হাজার টাকা যোগ করলে মোট খরচ দাঁড়ায় ৪২ হাজার টাকা। কিন্তু এবার শুধু আবাদেই খরচই হয়েছে ৪৫ হাজার। জমি ভাড়া ধরলে সেই খরচ দাঁড়ায় ৫২ হাজার টাকা। তবে গত বছর এক বিঘা জমিতে আলুর ফলন পাওয়া গেছে কমপক্ষ ১০০ মণ বা ৪ হাজার কেজি। তবে কোন কোন জমিতে ১১০ মণ পর্যন্তও ফলন এসেছিল। গড় ফলন ১০০ মণ ধরলে  গত বছর প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছিল ১০ টাকা ৫০ পয়সা। আর এবারের ৫২ হাজার টাকার বিপরীতে গড় ফলন ৭০ মণ ধরলে প্রতি কেজিতে খরচ আসে ১৮ টাকা ৫৭ পয়সা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় উৎপাদন খরচ প্রায় ৭৭ ভাগ বেড়েছে।

 


কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এবার রাসায়নিক সার ও বীজের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ৩গুণ বেশি কীটনাশক প্রয়োগ এবং সেচের খরচ ও শ্রমিকদের মজুরী বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। গত বছর এপ্রিলে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ও ড্যাপ বা ডিএপি সারের দাম প্রতি কেজিতে ৫ টাকা করে বৃদ্ধি করা হয়। এছাড়া জিপসামের দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ৩ টাকা এবং জিংক বা দস্তার দামও ২০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। একই ভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনও (বিএডিসি) তাদের আলু বীজের দাম ৩০ টাকা থেকে ২৪ টাকা বাড়িয়ে ৫৪ টাকা নির্ধারণ করেছে। 

 


কৃষক ও কৃষি বিভাগের হিসাবের গরমিল যে কারণে
কৃষি বিভাগ উৎপাদন খরচ বের করতে বীজ, সার (রাসায়নি এবং জৈব) ও কীটনাশক ক্রয় এবং জমি তৈরি, পানি সেচ, পরিচর্যা, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, শস্য রোপন, কর্তন এবং বাজারজাত করণে শ্রমের মূলের পাশাপাশি, জমির ভাড়া এবং বিনিয়োগ করা অর্থের সুদও বিবেচনায় নেয়। তবে কৃষকদের হিসাবে নিজের শ্রম এবং বিনিয়োগ করা অর্থের সুদের কোন হিসাব থাকে না। সেই হিসাবে কৃষি বিভাগের চেয়ে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টোই ঘটেছে।

 


অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলু আবাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক ও জৈব সার ব্যবহার, পরিমাণ, কীটনাশকের পরিমাণ ও মূল্য এবং মোট ফলনের হিসাবে বেশ ফারাক রয়েছে। আর এ কারণেই উৎপাদন খরচ নিয়ে কৃষক এবং  জেলা কৃষি বিভাগের হিসাবে গরমিল রয়ে গেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আলু উৎপাদনের খরচ বিবরণীতে প্রতি শতাংশ জমিতে ১ দশমিক ৩৫ কেজি ইউরিয়া, একই পরিমাণ এমওপি, শূন্য দশমিক ৯ কেজি টিএসপি, শূন্য দশমিক ৪৫ কেজি জিপসাম এবং শূন্য দশমিক শূন্য ৩৫ কেজি দস্তা সার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তবে আলু চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রতি শতাংশ জমিতে কৃষি বিভাগের উল্লেখ করা পরিমাণের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি ইউরিয়া (২.৭০ কেজি) সার ব্যবহার করেন। একইভাবে ২৩ শতাংশ বেশি এমওপি (১ দশমিক ৬৬ কেজি), পৌণে তিন গুণ বেশি টিএসপি (২.৫ কেজি), ৩৩ শতাংশ বেশি জিপসাম (শূন্য দশমিক ৬০ কেজি) এবং প্রায় আড়াই গুণেরও বেশি দস্তা (শূন্য দশমিক শূন্য ৯০ কেজি) সার ব্যবহার করেন। 

 


তবে অবাক করা তথ্য হলো যে আলু আবাদে কৃষক ডাইআমোনিয়াম ফসফেট বা ড্যাপ সার ব্যবহার করলেও সেটি কৃষি বিভাগের হিসাব বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়নি। আলু চাষীদের দেওয়া হিসাব অনুযায় তারা প্রতি শতাংশ জমিতে ১.০৪ কেজি ড্যাপ সার ব্যবহার করেন। কিন্তু ওই সারের মূল্য কৃষি বিভাগের হিসাবে রাখা হয় না। কৃষি বিভাগের চেয়ে অতিরিক্ত সার ছাড়াও ড্যাপ সার ব্যবহারের কারণে প্রতি শতাংশ জমিতে কৃষকের ১৪২ টাকা ২৮ পয়সা খরচ বেড়ে গেছে।

 


এর পাশাপাশি কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এক শতাংশ জমিতে কীটনাশক ব্যবহারে মাত্র ১০০ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে অথচ কৃষকদের প্রকৃত খরচের পরিমাণ ১৮০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। একইভাবে পানি সেচের খরচ প্রতি শতকে কৃষি বিভাগ ২২ টাকা ৫০ পয়সা ধরলেও কৃষকের খরচ হয়েছে ৪০ টাকা। এছাড়া জমি প্রস্তুত, শস্যকর্তন ও বাজারজাতকরণ খাতেও প্রতি শতাংশ জমিতে কৃষি বিভাগের দেখানো হিসাবের চেয়ে কৃষকের প্রকৃত খরচ যথাক্রমে ১৬ শতাংশ, ৩৩ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে কীটনাশক, সেচ, জমি প্রস্তুব, শস্য কর্তন ও বাজারজাতকরণ খাতে প্রতি শতাংশ জমিতে কৃষি বিভাগের দেখানো হিসাবের চেয়ে কৃষকের বাড়তি ১৪৪ টাকা ৫০ পয়সা খরচ হয়েছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এক শতাংশ জমিতে কৃষি বিভাগের হিসাবের চেয়ে কৃষকের বাড়তি খরচ হয়েছে ২৮৬ টাকা ৭৮ পয়সা।

 


ড্যাপ সার নিয়ে কৃষকের লুকোচুরি কেন?
 বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর এ জেলায় ৪১ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি ড্যাপ সার বরাদ্দ আসে। যা ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে বিক্রিও করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, কোন ফসলেই ড্যাপ সারের ব্যবহারের কথা কৃষি বিভাগ স্বীকার করে না। এমনকি কৃষকদের ড্যাপ সার প্রয়োগের তথ্য কেন গোপন করা হয় তার কারণও কর্মকর্তারা স্পষ্ট করে বলতে চান না। তবে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, ফসলের উৎপাদন খরচ নির্ণয়ের জন্য মন্ত্রণালয় নির্ধারিত ফরমে ড্যাপ সারের নাম নেই। আর সে কারণেই কৃষক ব্যবহার করলেও মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা উৎপাদন খরচের হিসাবে ড্যাপ সারের ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করতে পারেন না।
কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউরিয়া ও টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সারের ব্যবহার কমাতেই সরকারিভাবে ড্যাপ-এর ব্যবহার বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কেননা ১ কেজি ড্যাপ সারের মধ্যে ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৬০০গ্রাম টিএসপি’র গুণাগুণ রয়েছে। অর্থাৎ ৫০ কেজির এক বস্তা ড্যাপ সার ব্যবহার করলে কৃষকদের ইউরিয়া ২০ কেজি কম এবং ৩০ কেজি টিএসপি কম কিনতে হতো। এজন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ড্যাপ সারের পক্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও চালানো হয়। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই ঘটেছে। কারণ কৃষক ড্যাপ সার ব্যবহার করলেও ইউরিয়া এবং টিএসপি’র ব্যবহার কমাননি এতটুকুও।

 


কৃষি বিভাগের উৎপাদন খরচের সঙ্গে কৃষকের হিসাবের গরমিলে সমস্যা কোথায়?
জেলা কৃষি বিভাগের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী এবার যেহেতু স্টিক জাতের আলু ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করলে কৃষক লাভবান হবেন। তবে কৃষকের হিসাবে এক মণ আলুর উৎপাদন খরচই পড়েছে ৭৪৩ টাকা। প্রায় দেড় সপ্তাহ আগে শিবগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে স্টিক জাতের ভেজা (জমিতে উত্তোলন করা) আলু ৬০০ টাকা মণ আর শুকনা (উত্তোলনের পর কয়েক দিন রাখা হয়) আলু ৭০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। শিবগঞ্জ উপজেলার পীরব এলাকার জহুরুল ইসলাম নামে এক আলু চাষী আক্ষেপ করে বলেন, সরকারের হিসাবে ধরলে ভেজা আলু ৬০০ টাকায় বিক্রি করলে আমরা ৪০ টাকা লাভ পাব। কিন্তু বাস্তবে ভেজা আর শুকনা কোন আলু বিক্রি করেই আমরা লাভ করতে পারছি না। ভেজা আলু বিক্রি করে প্রতি মণে ১৪৩ টাকা লোকসান হচ্ছে আর আর শুকনা আলু বিক্রি করলে সেই লোকসান ৪৩ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে।

 


তাহলে কি এবার আলুতে সত্যি লাভ করেন নি? এমন প্রশ্নের জবাবে কয়েকজন চাষী বলেন,  দেড় মাস আগে যারা আলু বিক্রি করতে পেরেছেন তারা কিছুটা লাভ করেছেন। কারণ তখন ক্ষেতেই প্রতি মণ আলু ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। ফলে তখন কৃষক প্রতি মণ আলুতে ৩৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত লাভ করতে পেরেছেন। এছাড়া আরও আগে যারা আগাম আলু বিক্রি করেছেন তারাও প্রতি মণে বেশ ভাল লাভ পেয়েছেন। কিন্তু সেইসব লাভবান কৃষকের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
কৃষি বিভাগের উৎপাদন খরচের সঙ্গে কৃষকদের খরচের গরমিলের সমস্যার কথা জানতে চাইলে একাধিক কৃষক নাম প্রকাশ করার শর্তে বলেন, কৃষি বিভাগের হিসাব সরকারের সব দপ্তর সংরক্ষণ করে। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের কাছেও চলে যায়। ফলে আমরা যখনই আমাদের উৎপাদন খরচ অনুযায়ী দাম চাইবো তখন তারা কৃষি বিভাগের দেখানো উৎপাদন খরচের তালিকা নিয়ে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করবে। সেই সুযোগে ফড়িয়া আর আড়ৎ মালিকরা আমাদের লোকসানে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। তবে বর্তমানে আলু বিক্রি করে যে লোকসান হচ্ছে সেটি যাতে বেশিদিন গুণতে না হয় সেজন্য কৃষকরা এরই মধ্যে আলু হিমাগারে মজুদ শুরু করেছেন। তার পর যখন আলুর দাম বাড়তে শুরু করবে তখন তারা বিক্রি করতে শুরু করবেন। জানতে চাইলে বগুড়ার মহাস্থান বাজারের পাইকাড়ি আড়ৎ সফুরা ভাণ্ডারের কর্ণধার শফিকুল ইসলাম বলেন, কিছু কিছু কৃষক আলু হিমাগারে রাখতে শুরু করেছন। আগামী ১ মার্চ থেকে এটা আরও বাড়বে। তখনকার বাজার পরিস্থিতি কি হয় সেটি বলা যাচ্ছে না।

 


সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান-এর বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, কৃষি বিভাগ তাদের নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকদের সার ও কীটনাশক প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছেন। সে কারণে কৃষক তার নির্ধারিত পরিমাণের চাইতে কয়েকগুণ বেশি সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। এতে তাদের উৎপাদন খরচও বাড়ছে। এবার আলুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু কৃষি বিভাগ নিজেদের ব্যর্থতার দায় নিতে চান না। আবার কৃষকের বাড়তি সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কথাও স্বীকার করতে চান না। যে কারণে তারা আলুর মনগড় উৎপাদন খরচ তৈরি করেছে। এটা দেশের জন্য ক্ষতিকর। তিনি বলেন, কৃষকদের অবশ্যই সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সার প্রয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। সেটা যতদিন না সম্ভব হয় ততদিন তাদের উৎপাদিত ফসলের প্রকৃত খরচের বিবরণ উল্লেখ করতে হবে। এটি না করলে বাজার ব্যস্থাপনায় জটিলতা সৃষ্টি হবে।

 


আলুর উৎপাদন খরচের হিসাব নিয়ে কৃষি বিভাগের সঙ্গে কৃষকের গরমিলের কারণ জানতে চাইলে বুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান বলেন, আলু আবাদে সার ও কীটনাশক প্রয়োগের নির্ধারিত যে নীতিমালা রয়েছে আমরা সেই অনুযায়ী উৎপাদন খরচের হিসাব করে থাকি। এবার কুয়াশার কারণে রোগবালাই কিছুটা বেশি হয়েছিল। কিন্তু সেটি প্রতিরোধে যেভাবে কীটনাশক প্রয়োগের কথা কৃষক তা না করে নিজের ইচ্ছেমত প্রয়োগ করেছেন। একইভাবে তারা হয়তো সারও অতিরিক্ত ব্যবহার করেছেন। এসব করতে গিয়ে তারা খরচ বাড়াতে পারেন। কৃষক ড্যাপ সার ব্যবহার করলেও সেটির বিবরণ উৎপাদন খরচের হিসাবে যুক্ত না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খরচের এই বিবরণীটি সেন্ট্রালি তৈরি করা হয়েছে। আমরা সেটিকে অনুসরণ করি।’ মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের প্রকৃত খরচ উল্লেখ করতে চাইলেও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেটি গ্রহণ করতে চান না এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি এটা বলে থাকে তাহলে তিনি সঠিক কথা বলেন নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আলুসহ সব ফসলে  কৃষি বিভাগের নির্ধারণ করে দেওয়া মাত্রায় সার প্রয়োগ করেও যে ভাল ফলন পাওয়া যায় সেটি দেখানের জন্য তারা অনেক ফসলের প্রদর্শনী খামার তৈরি করেন। এগুলো দেখে কৃষকরা ধীরে ধীরে অধিক সার ব্যবহার থেকে সরে আসছেন।