তিলে তিলে জমানো ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন নেতা-কর্মীরা
বগুড়ায় প্রভাবশালী আ’লীগ নেতা রবিন যে কারণে হারলেন
বিশেষ প্রতিবেদন
প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বগুড়ার গাবতলীতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা বর্তমান চেয়ারম্যান রফি নেওয়াজ খান রবিনের পরাজয় শাসক দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিশেষত যারা আগামীতে অনুষ্ঠিতব্য উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্ব›দ্বীতায় অবতীর্ণ হয়েছেন তাদেরকে বেশ বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। আগামী ২১ মে থেকে ৫ জুনের মধ্যে তিনটি ধাপে জেলার আরও ৯টি উপজেলায় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
শাসক দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বগুড়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি রফি নেওয়াজ খান রবিন ২০১৯ সালে দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেই রবিনই এবার একাধিক কেন্দ্রের প্রিসাইডিং ও সহকারি প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করেও কেন নবাগত এক প্রার্থীর কাছে পরাজিত হলেন তা অনেকেই জানার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ এ নিয়ে রীতিমত শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। এমনকি তার পরাজয়ের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লেখালেখিও হচ্ছে।
রবিনের পরাজয়ের কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে পুণ্ড্রকথা। এজন্য বগুড়া ও গাবতলীতে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সাংবাদিক ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা রবিনের পরাজয়ের পেছনে মূলত দলীয় নেতা-কর্মীদের পঞ্চিভুত ক্ষোভকেই দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, ত্যাগী নেতা-কর্মীরা সুযোগ পেয়ে রবিনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন।
গত বুধবার (৮ মে) গাবতলীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফি নেওয়াজ খান রবিন পরাজিত হয়েছেন নবাগত প্রার্থী একই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য অরুণ কান্তি রায় সিটনের কাছে। সিটন গাবতলীর বাসিন্দা হলেও তিনি দীর্ঘদিন ধরে বগুড়ার বাইরে অবস্থান করছিলেন। নির্বাচনের আগ মুহুর্তে তিনি এলাকায় সক্রিয় হন। নির্বাচনে বিজয়ী সিটনের ঘোড়া প্রতীকে পড়ে ৪১ হাজার ৬০৯ ভোট। আর রবিনের আনারস প্রতীকে পড়ে ৩৯ হাজার ৭৫২ ভোট। অথচ ২০১৯ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে রবিন প্রায় দেড় লাখ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছিলেন ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৪০ ভোট। তখন তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী পেয়েছিলেন মাত্র ২ হাজার ৬৭৪ ভোট। নির্বাচনে ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, রফি নেওয়াজ খান রবিন ১৯৯৪ সালে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তারপর ১৯৯৯ সালে তিনি সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিন বছরের মাথায় রবিন বগুড়া পৌর আওয়ামী লীগের আহবায়ক হন। এরপর ২০১৯ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনও হয়নি। এর ফাঁকে রবিন তার নিজ এলাকা গাবতলীর রামেশ^রপুরে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এছাড়া তিনি বগুড়া শহরের ঐতিহ্যবাহী ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। শত বছরের প্রাচীন বগুড়া বড় মসজিদেরও সাধারণ সম্পাদক হন রবিন।
২০১৯ সালে গাবতলী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রথমে রবিনের শ^শুর আযম খান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু তার আকস্মিক মৃত্যু হলে রফি নেওয়াজ খান রবিনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ওই সময় গাবতলীতে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা রবিনকে ‘উপযুক্ত নেতা’ হিসেবে মেনে নেন। তবে অনেক ত্যাগী নেতা থাকার পরেও ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারিতে আওয়ামী লীগের উপজেলা কমিটি গঠনের সময় রবিন তার শ্যালক ফয়সাল খান জনিকে দলের সাধারণ সম্পাদক পদে বসান। সভাপতি করেন তারই আস্থাভাজন মোস্তফা আব্দুর রাজ্জাক মিলুকে।
স্বজনদের নিয়ে এভাবে পকেট কমিটি গঠনের কারণে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা রবিনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সেই ক্ষোভ তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে রবিন পছন্দের নেতা-কর্মী ও স্বজন ছাড়া তেমন কাউকে কোন সুযোগ-সুবিধা দেননি বা চেষ্টাও করেননি। উল্টো তাদের সঙ্গে দাম্ভিক আচরণ করেছেন। এমনকি ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫জন ছাড়া অন্য ৭জনকে তেমন পাত্তা দেননি। একই ধরনের আচরণ করেছন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের সঙ্গেও। এক পর্যায়ে রবিন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি করেন। এসব কারণে বঞ্চনার শিকার নিজ দলের নেতা-কর্মী এবং ক্ষুব্ধ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রফি নেওয়াজ খান রবিনের ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠেন। বলা হচ্ছে, দিনে দিনে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ ও বিরক্তি থেকে ওই পক্ষগুলো নিজেদের অস্তিত্ব ও মর্যাদা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘রবিন ঠেকাও’-এর মিশন নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। দলীয় প্রতীক ছাড়া উপজেলা নির্বাচন আয়োজনকে তারা মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বেছে নেয়। তারা রবিনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে এমন যে কোন একজনকে সমর্থন দেওয়ার পরিকল্পনা করে। সেক্ষেত্রে তারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা অরুণ কান্তি রায় সিটনকেই বেছে নেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু নিজ দলেরই নয় প্রতিপক্ষ বিএনপি’র নেতা-কর্মীরাও রফি নেওয়াজ খান রবিনের আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি হিসেবে পরিচিত বগুড়ার গাবতলীতে ওই দলের নেতা-কর্মীরা রবিনের কারণে স্বাভাবিকভাবে কোন কর্মসূচীই পালন করতে পারতেন না। তাদের অভিযোগ, রবিন কখনও নিজের ক্যাডার বাহিনীকে লেলিয়ে আবার কখনও পুলিশকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতেন। এ কারণে বিএনপি নেতা-কর্মীরাও গোপনে রবিন ঠেকাও মিশনে শরীক হয়। নিজেদের সাংগঠনিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ওই দলটির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাদের ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মীদেরকে রবিনের বিপক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দেন।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, দলীয় প্রতীক না থাকায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বেঁকে বসতে পারে এটা আাঁচ করতে পেরে রফি নেওয়াজ খান রবিন নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। কিন্তু তাতে আশানুরূপ সাড়া পাননি। উল্টো কোন কোন নেতা রবিনের প্রতিদ্ব›দ্বী অরুণ কান্তি রায় সিটনকে কাছে টেন নেন এবং সমর্থন দিতে শুরু করেন। শুধু কি তাই আওয়ামী লীগ দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. মোস্তফা আলম নাননুও উপজেলা নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকার ঘোষণা দেন। এতে রবিন শঙ্কিত হয়ে পড়েন।
ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে চরম বেকায়দায় পড়ে রফি নেওয়াজ খান রবিন তার জয় নিশ্চিত করতে বিকল্প হিসেবে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ম্যানেজের পরিকল্পনা করেন। অভিযোগ রয়েছে, ৯৮টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে রবিন অন্তত ৩০টি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং, সহকারি প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে তার পক্ষে কাজ করাতে চেয়েছিলেন। নির্বাচন চলাকালে গাবতলী উপজেলার রামেশ^রপুর ইউনিয়নের মাঝপাড়া কুসুমকলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সোনারায় উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে তার পক্ষে জাল ভোট দেওয়ার ঘটনা ধরা পড়ার ওই বিষয়টি জানাজানি হয়। ওইদিন ৩০০টি জাল ভোট দেওয়ার অপরাধে ৫০ হাজার টাকাসহ আটক এমদাদ হোসেন নামে রবিনের এক এজেন্টকে আদালত ১ বছর কারাদÐ প্রদান করেন। এছাড়া শাজাহান আলী, হাফিজার রহমান, আব্দুল মোত্তালিব ও এটিএম আমিনুল ইসলাম নামে অপর চার নির্বাচনী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে প্রশাসন।
বুধবার গাবতলী উপজেলা নির্বাচনে যে ব্যাপক জালভোট প্রদানের ঘটনা ঘটেছে রাতে ফলাফল ঘোষণার পর তা আরও নিশ্চিত হয়ে যায়। স্থানীয় উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানিয়েছেন, ফলাফল গণনার সময় গাবতলীতে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ১২১টি ভোট বাতিল করতে হয়েছে। অথচ একই দিন অনুষ্ঠিত অপর দুই উপজেলার মধ্যে সোনাতলায় মাত্র ৫৯৯টি এবং সারিয়াকান্দিতে ১ হাজার ৫৯৩টি ব্যালট বাতিল হয়েছে। কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে, সেখানে বাতিল করা ব্যালটের বেশিভারগই জাল ভোট দেওয়া হয়েছিল।
গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম ভুলন জানিয়েছেন, রফি নেওয়াজ খান রবিন আমাদের মত সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে রাজনীতি করেছেন। অপমানে-দুঃখে আমিসহ অনেকে রাজনীতি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। তিনি বলেন, ‘ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কেউ এবরের নির্বাচনে রবিনের পক্ষে ছিল না। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরাও তার পক্ষে ছিল না।’ তবে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভের কারণে রফি নেওয়াজ খান রবিনের পরাজয় হয়েছ-এমনটা মানতে নারাজ গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তফা আব্দুর রাজ্জাক মিলু। বরং তার দাবি, অরুণ কান্তি রায় সিটন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সিংহভাগ ভোট পেয়েছেন বলেই বিজয়ী হয়েছেন।