মেম্বার চেয়ারম্যান এবং এমপি এক ছাদের নিচে

সেই রাজুর বাড়ি এখন যেন এক ‘পাওয়ার হাউস’

বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৪ ০৯:১২ ।
দেশের খবর
পঠিত হয়েছে ৫৩ বার।

রাজনীতিকে যদি ‘কৌশলের খেলা’ বলা হয় তাহলে নিঃসন্দেহে সেই খেলায় জয়ী হয়েছেন বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সিরাজুল ইসলাম খান রাজু। কারণ তিনি স্ত্রী মঞ্জুয়ারা খাতুনকে জেলা পরিষদে এবং ছেলে খান মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ আল মেহেদি বাধনকে জাতীয় সংসদে পাঠানোর (এমপি নির্বাচিত) পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজেও উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন। 

 


যদিও এবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকায় সিরাজুল ইসলাম খান রাজুর জয় নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। এ কারণে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা খানিকটা উৎকণ্ঠায় ছিলেন। তবে মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে আদমদীঘি ইউএনও’র কার্যালয় থেকে ভোট গণনা শেষে যখন চেয়ারম্যান পদে রাজুকে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর চেয়ে প্রায় ৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় তখন কাছেই তার বাড়িতে রীতিমত যেন উৎসব শুরু হয়।

 


সিরাজুল ইসলাম খান রাজুর এই জয়ের মধ্য দিয়ে তার বাড়িটি এখন সমর্থকদের কাছে ‘পাওয়ার হাউস’ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। কারণ ওই এক বাড়িতেই যে, জেলা পরিষদের মেম্বার, উপজেলা চেয়ারম্যান আর এমপি’র বসবাস। বগুড়ায় এমন বাড়িটি আর দ্বিতীয়টি নেই। অবশ্য এর আগে গত ৮ মে অনুষ্ঠিত সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজল নির্বাচিত হন।

 


তবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এভাবে একই বাড়ির তিন সদস্যের এমন ক্ষমতাধর হয়ে ওঠাকে গণতন্ত্রকের জন্য শুভকর কিছু নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলছেন, সিরাজুল ইসলাম খান রাজু, তার স্ত্রী এবং সন্তান যদি ক্ষমাতার মোহে জবাবদীহিতার বাইরে গিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন তাহলে স্থানীয় জনগণের যাওয়ার কোন জায়গা থাকবে না। তারা পদে পদে ভোগান্তির শিকার হবেন। পরিবারটির সদস্যরা যাতে জনগণকে তাদের প্রাপ্য সেবা দিতে পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য তারা সরকারের নজরদারিও কামনা করেছেন।

 


রাজনীতিতে রাজু এবং তার পরিবারের উত্থান
সিরাজুল ইসলাম খান রাজু এবং তার স্ত্রী মঞ্জুয়ারা খাতুন এখন আদমদীঘিতে আওয়ামী লীগ এবং মহিলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদ দখল করলেও শুরুতে তারা কিন্তু কেউই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। শুধুমাত্র ক্ষমতার স্বাদ নিতেই তারা সুযোগ বুঝে পূর্বেকার ‘রাজনৈতিক আদর্শ’ বিসর্জন দিয়ে হয়েছেন ‘আওয়ামী লীগা’র। এমনকি ছেলেকেও ‘উত্তরাধিকার সূত্রে’ আওয়ামী লীগে এনে বসিয়েছেন আদমদীঘি উপজেলা কমিটির যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে।

 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিরাজুল ইসলাম খান রাজু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নেতা প্রয়াত এবিএম শাজাহানের মাধ্যমে ওই দলে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি গণবাহিনীর সদস্য হন। এরপর এবিএম শাজাহানের নেতৃত্বেই রাজু ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন এবং দলটির আদমদীঘি উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিলের মাধ্যমে ওই দলে যোগ দেন। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। অবশ্য রাজু এর আগে আদমদীঘি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে অন্তত ৫ বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আওয়ামী লীগে তার প্রভাব বাড়াতে সমর্থ হন এবং ২০১২ সালে দলটির আদমদীঘি উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন। 

 

নিজেই এমপি হতে চেয়েছিনে রাজু
২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় রাজুর স্ত্রী মঞ্জুয়ারা খাতুন খুব সহজেই সদস্য পদে নির্বাচিত হন। একইভাবে ওই দলটি ২০১৯ সালে উপজেলা নির্বাচন বর্জন করলে সিরাজুল ইসলাম খান বিনা বাধায় চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন। ২০২০ সালে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন এবং সেই কমিটিতে যুব ও ক্রীড়া সম্পাদকের পদে বসান ছেলে খান মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ আল মেহেদি বাধনকে। ওই একই বছর তিনি তার স্ত্রী মঞ্জুয়ারা খাতুনকে উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের পদে বসান। এরপর ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে মঞ্জুয়ারা খাতুন দ্বিতীয় দফায় জেলা পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। 

 


উপজেলার রাজনীতিতে ‘সফল’ রাজু এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। প্রস্তুতি হিসেবে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগও করেন। পরে বগুড়া-৩ (আদমদীঘি ও দুপচাঁচিয়া উপজেলা) আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে এমন শঙ্কা থেকে রাজু নিজে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও ‘স্বতন্ত্র’ হিসেবে ছেলে বাধনকেও প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন। পরে প্রার্থীতা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়ে রাজু তার ছেলেকে জেতাতে ভোটের মাঠের বড় খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হন।

 


 বিএনপি সমর্থক প্রার্থী রাজুর জয়কে সহজ করেছে
আদমদীঘি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে সিরাজুল ইসলাম রাজুর প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন দু’জন। তারা হলেন আদমদীঘি উপজেলা শ্রমিক লীগের সাবেক আহবায়ক রাশেদুল ইসলাম রাজা এবং বিএনপি সমর্থক তোফায়েল হোসেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ রাজুর আনারস প্রতীকের পক্ষে কাজ করলেও অপর অংশ শ্রমিক লীগ নেতা রাজার মোটর সাইকেল প্রতীকের জন্য ভোটারদের কাছে রাত-দিন ছুটেছেন। ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’-এই কৌশলের অংশ হিসেবে তারা বিএনপি সমর্থক ভোটারদের কাছেও ধর্ণা দিয়েছেন। এতে রাজার মোটর সাইকেলের প্রতি ঝুকলেও বিএনপি সমর্থকদের একটি অংশ তোফায়েল হোসেনের ঘোড়া প্রতীকের প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে বিএনপি সমর্থকদের ভোট মোটর সাইকেল আর ঘোড়ায় ভাগাভাগি হয়ে যায়। আর তাত্ইে রাজুর বিজয় সহজ হয়ে যায়। মঙ্গলবার রাতে ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে জেলার তিনটি উপজেলার মধ্যে আদমদীঘিতে সবচেয়ে বেশি ৪৫ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। নির্বাচনে সিরাজুল ইসলাম খান রাজুর আনারস প্রতীকে পড়ে ৩৯ হাজার ৮৩২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী শ্রমিক লীগ নেতা রাশেদুল ইসলাম রাজার মোটর সাইকেল প্রতীকে পড়েছে ৩২ হাজার ১২৮ ভোট। দু’জনের ভোটের ব্যবধান মাত্র ৭ হাজার ৭০৪। পক্ষান্তরে বিএনপি সমর্থক তোফায়েল আহমেদের ঘোড়ায় পড়েছে ৩ হাজার ৯১৯ ভোট। নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যদি তোফায়েল যদি প্রার্থী না হতেন তাহলে তার ভোটগুলো রাশেদুল ইসলাম রাজার মোটর সাইকেল পড়তো। তাতে রাজুর জয় কঠিন হয়ে যেতো।

 


সুশাসনের জন্য প্রচারভিযানের (সুপ্র) বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, ক্ষমতাসীন দল যদি তাদের নীতি পরিবর্তন না করে এবং নির্বাচন কমিশন যদি বিএনপি’র মত বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দলকে ভোটে আনতে না পারে তাহলে আগামীতে কোন নির্বাচনেই জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে না। সেক্ষেত্রে অনেকেই সিরাজুল ইসলাম খান রাজুর মত এক বাড়িতে সব ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করবেন।

 


এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য আদমদীঘি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম খান রাজু এবং তার ছেলে বগুড়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য খান মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ আল মেহেদি বাধনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভ করেন নি। যে কারণে তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।