নির্বাচন অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে পৌর পরিষদ গঠনের দাবি সুশীল সমাজের
বগুড়া পৌরসভায় কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালনে বিরক্ত সরকারি কর্মকর্তারা, সেবা পেতে ভোগান্তিও বেড়েছে
স্টাফ রিপোর্টার
‘এলাকায় কোন বিষয় নিয়ে বিরোধ হলে লোকজন সেই ভোরে বাসায় এসে ডাকাডাকি করেন। বসত-বাড়ি নির্মাণের সময় কোন সমস্যা হলে অফিস ছেড়ে তাৎক্ষণিভাবে ঘটনাস্থলে ছুটে যেতে হচ্ছে। নতুন ভোটার হওয়ার জন্য কিংবা নাম সংশোধনের আবেদন নিয়ে আসা লোকজনদের তাৎক্ষণিক সেবা দিতে না পারলে অফিসের ভেতরে-বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি করা হয়। এসব নিয়ে মাঝে মাঝে খুব বিব্রত হতে হয়।’ কাউন্সিলরদের অপসারণের পর ওই পদে অর্পিত দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাগুলো এভাবেই বর্ণনা করছিলেন বগুড়ায় সরকারি দপ্তরের শীর্ষ এক কর্মকর্তা। বগুড়া ‘পৌরসভার পরিচালনা সহায়ক কমিটির সদস্য’ হিসেবে তাকে ৩টি ওয়ার্ডে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১৪ দিনের মাথায় ১৯ আগস্ট সারাদেশের মত বগুড়া পৌরসভার মেয়রকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বগুড়া পৌরসভায় প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মাসুম আলী বেগকে। তিনি গত ২০ আগস্ট প্রশাসকের দায়িত্ব বুঝে নেন। ১০ লাখ নাগরিকের অধ্যুষিত এই পৌরসভার ২১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত ৭ মহিলা কাউন্সিলরকেও সরিয়ে দেওয়া হয় ২৬ সেপ্টেম্বর। কাউন্সিলরদের স্থলে জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের শীর্ষ ৮ কর্মকর্তাকে পৗরসভার পরিচালনা সহায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে গত ৯ অক্টোবর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মূলত জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত প্রত্যয়ন ও উত্তরাধিকার (ওয়ারিশান) সংক্রান্ত সনদসহ ১৪ ধরনের সনদ কিংবা প্রত্যয়ন প্রদানের ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়। কাউন্সিলরদের পরিবর্তে দায়িত্ব পালনকারী সরকারি ওই ৮ শীর্ষ কর্মকর্তার কাজে সহায়তার জন্য পৌরসভার ২১টি ওয়ার্ডে চুক্তি ভিত্তিক ২১জন ওয়ার্ড সহকারিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়ার্ড সহকারিরা ওয়ার্ড পর্যায়ে পৌরসভার নিজস্ব অথবা ভাড়া করা কার্যালয়ে বসে দায়িত্ব পালন করলেও পৌরসভার পরিচালনা সহায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা কিন্তু নিজ নিজ দপ্তরে বসেই ‘জনপ্রতিনিধি’র কাজ করছেন। এর ফলে বর্তমানে একজন নাগরিককে তার প্রাপ্য সেবা পেতে ওই দুই দপ্তরের পাশাপাশি পৌরসভা ভবনেও ছুটতে হচ্ছে। এভাবে তিনটি স্থানে ছোটাছুটির কারণে নাগরিকদের ভোগান্তিও বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মৃত ব্যক্তিদের উত্তরাধিকার তথা ‘ওয়ারিশান সনদ’ প্রাপ্তিতে। মেয়র ও কাউন্সিলররা যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন যে ওয়ারিশান সনদ কয়েক ঘন্টায় পাওয়া যেত এখন সেটি পেতে ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
শহরের বড় বেলাইল এলাকার সেলিম খান তার পিতার মৃত্যুর পর ওয়ারিশান সনদের জন্য ৩১ অক্টোবর আবেদন করেছিলেন। যাচাই-বাছাই শেষে তাকে সেটি ১০ নভেম্বর সরবরাহ করা হয়। সেলিম খান বলেন, আগে যখন কাউন্সিলররা দায়িত্বে ছিলেন তখন এসব ওয়ারিশান সনদ এক দিনের মধ্যেই পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন বেশ বিলম্বিত হচ্ছে। এতে জনগণের ভোগান্তিও বেড়েছে। ওয়ারিশান সনদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বগুড়া পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, আবেদনের পর পরই যাতে দ্রæত ওয়ারিশান সনদ প্রদান করা যায় সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে গতিও আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসে যেখানে মাত্র ৯২টি ওয়ারিশান সনদ ইস্যু করা হয়েছিল অক্টোবর মাসে তা ১৫৭টিতে গিয়ে পৌঁছেছে। যা গত জুন মাসের চেয়েও বেশি।
শহরের সুলতানগঞ্জ পাড়ার মহরম আলী নামে একজন জানালেন, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ায় ভোটার তালিকায় তিনি তার ছেলের নাম অন্তর্ভূক্তির জন্য ১, ৪ এবং ৫ ওয়ার্ডের জন্য পৌরসভার পরিচালনা সহায়ক সদস্য হিসেবে কদিন আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তার অফিসে মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় আবেদন ফরমে স্বাক্ষর নিতেই ৪ ঘন্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। যা খুবই বিরক্তিকর ছিল। তিনি বলেন, ‘তিনি তো একটি অফিসের প্রধান। তার তো মিটিং থাকতেই পারে। তাই কষ্ট সত্তে¡ও অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। তবে এগুলো যাতে দ্রæত পাওয়া যায় সেটা নিশ্চিত করতে হয় বিকল্প কোন পদক্ষেপ নিতে হবে নয়তো দ্রæত নির্বাচন দিতে হবে।’ বগুড়া পৌরসভার ১, ৪ এবং ৫নং ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার রেজোয়ান হোসেন জানান, তারা নিজ দপ্তরের কাজের পাশাপাশি প্রত্যেক সেবা প্রার্থীকেই দ্রæত সেবা প্রদানের চেষ্টা করেন। তবে কখনও মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকলে হয়তো সেবা প্রার্থীদের কিছুটা সময় অপেক্ষা করাতে হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিব্রতকর পরস্থিতিতে পরতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ওয়ারিশান সনদ গ্রহণের ক্ষেত্রে কেউ কেউ তথ্য গোপনের চেষ্টা করেন। এজন্য আমাদের অনেক কিছু যাচাই-বাছাই করতে হয়। সেটা করতে গিয়ে কখনও কখনও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়।
তবে ব্যতিক্রম চিত্র লক্ষ্য করা গেেছ বাড়ি নির্মাণের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে। ওই ক্ষেত্রে গতি ধীর হলেও নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কাউকে কোন উৎকোচ দিতে হচ্ছে না। ভুক্তভোগীরা বলছেন, আগে কোন কোন কাউন্সিলরকে তাদের চাহিদা মত উৎকোচ না দিলে নকশা অনুমোদন করা হতো না। শহরের একটি এলাকার এক বাসিন্দা জানান্, তিনি গত জুন মাসে তার বাড়ির নকশা অনুমোদনের জন্য পৌরসভায় জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর তার কাছে ‘ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করে বলেছিলেন টাকা না দিলে নকশা পাবেন না। তার পক্ষে ১ লাখ টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না বলে তিনি আর অগ্রসর হননি। তবে পৌরসভার কাউন্সিলরদের সরিয়ে দেওয়ার পর তিনি জানতে পারেন যে, কোন উৎকোচ ছাড়াই নকশা অনুমোদন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘খবরটি পেয়ে আমি আবেদন করি এবং কোন উৎকোচ ছাড়াই বাড়ির সেই নকশাটি অনুমোদন পেয়ে যাই।’ বগুড়া পৌরসভার শহর পরিকল্পনাবিদ আল মেহেদী হাসান জানান, প্রশাসক দায়িত্ব গ্রহণের পর নকশা অনুমোদন সংক্রান্ত কমিটির দু’টি সভা হয়েছে। তাতে ২৮৮টি নকশার মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ২৫৫টি নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নকশা অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কোন বিলম্ব হচ্ছে না। আগের গতিতেই অনুমোদন প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরো বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আসাদুল হক কাজল পৌরসভার নাগরিক সেবায় গতি ফিরিয়ে আনতে দ্রæত নির্বাচন দাবি করে বলেছেন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান পৌরসভার সেবা প্রয়োজন হয়। তিনি বলেন, মেয়র এবং কাউন্সিলদের অবর্তমানে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা একেতো স্থানীয় বাসিন্দা নন তারওপর তারা প্রত্যেকে সরকারি দপ্তরগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তা। কাজেই ইচ্ছা থাকলেও তাদের পক্ষে দ্রæত সেবা প্রদান করা সম্ভব নয়। এজন্য নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রয়োজন। তবে এখন যদি নির্বাচন দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে স্থানীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে পৌর পরিষদ গঠন করা যেতে পারে। তাতে জনগণ উপকৃত হবেন।
বগুড়া পৌরসভার প্রশাসক মাসুম আলী বেগ জানান, নাগরিকরা যাতে তাদের সেবাগুলো দ্রæত পেতে পারেন সেজন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে জিনি জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এই পৌরসভায় ১৬৬জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ থাকলেও কাজ করছেন মাত্র ৬২জন। পৌরসভার আয় সীমিত হওয়ায় শূন্য পদে জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া ওয়ার্ড সহকারি হিসেবে যারা কাজ করছেন তারাও স্থায়ী কর্মচারী নন ফলে সেখানেও কিছু সমস্যা রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতা নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে প্রশাসক মাসুম আলী বেগ বলেন, ‘বগুড়া পৌরসভায় সড়ক পাকা কিংবা সংস্কার সংক্রান্ত আবেদন বেশি জমা পড়ছে। যেগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে অন্তত ১০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে।’