দূর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে

বগুড়ায় সিএনজি অটোরিকশার ৮৬ শতাংশের নেই ফিটনেস: সিলিন্ডারগুলোও মেয়াদ উত্তীর্ণ

বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:২০ ।
দেশের খবর
পঠিত হয়েছে ২৭ বার।

বগুড়া শহর এবং উপজেলা পর্যায়ে চলাচলত সিএনজি চালিত অটোরিকশাগুলোর মধ্যে গড়ে ৮৬ শতাংশেরই ফিটনেস নেই। ফিটনেস বিহীন সিএনজি চালিত অটোরিকশায় যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রায়ই প্রতিদিনই দূর্ঘটনা ঘটছে। তবে যেহেতু কেউ নিহত না হলে তা গণমাধ্যমের নজরে আসে না তাই সবগুলো দুর্ঘটনার বিবরণও পাওয়া যায় না। অবশ্য স্থানীয় এবং জাতীয় পত্রিকার অনলাইন এবং প্রিন্ট ভার্সনে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে গত দুই বছরে (২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) বগুড়ায় অর্ধশতেরও বেশি দূর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় থাকা শিশু এবং নারীসহ ১৫জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।

 


বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রতি বছর সিএনজি চালিত অটোরিকশার ফিটনেস অর্থাৎ সেটি যাত্রী পরিবহনের সক্ষম কি’না সেটি পরীক্ষা করে থাকে। প্রতি বছর নির্ধারিত ফি প্রদান সাপেক্ষে ফিটনেস সনদ নবায়নের ক্ষেত্রে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ মূলত অটোরিকশার কাঠামো এবং তাতে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার-এর রি টেস্ট সনদ অর্থাৎ সেটি নতুন করে গ্যাসের চাপ নিতে আদৌ সক্ষম কি’না সে সম্পর্কিত পরীক্ষার ফলাফল দেখে থাকে। যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে ওই দু’টি বিষয় যেহেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই সেগুলোর ইতিবাচক ফলাফল পেলেই কেবল ফিটনেস সনদ নবায়ন করা হয়। 

 


বগুড়ায় বিআরটিএ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রায় কুড়ি বছর আগে ২০০৫ সালে বগুড়ায় পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। এরপর দু’ বছরের মাথায় ২০০৭ সালে সিএনজি ফিলিং স্টেশন চালু হলে অটোরিকশার রেজিস্ট্রেশন প্রদান শুরু হয়। তার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জেলায় মোট ৭ হাজার ৬৫৮টি অটোরিকশাকে রেজিস্ট্রেশন প্রদান করা হয়েছে। তবে বাস্তবে এর প্রায় ৪গুণ বেশি প্রায় ৩০ হাজার সিএনজি চালিত অটোরিকশা চলাচল করে থাকে। প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার সিএনজি চালিত অটোরিকশা সড়কে নামছে। বিআরটিএ’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশন নেওয়া সিএনজি চালিত অটোরিকশাগুলোর মধ্যে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮৬ শতাংশ অর্থাৎ ৬ হাজার ৪৩৩টিই ফিটনেস সনদ নবায়ন করেনি। আর রেজিস্ট্রেশনবিহীন ২২ হাজার সিএনজি চালিত অটোরিকশা তো পুরোপুরি অবৈধভাবে চলাচল করছে।

 


বিআরটিএ সূত্র জানায়, অন্যান্য যানবাহনের মত সিএনজি চালিত অটোরিকশাগুলোরও প্রতি বছর ফিটনেস সদন নবায়ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেটি না করলে দন্ড হিসেবে প্রতিমাসেই জরিমানার অর্থ গুণতে হয়। তবে সিএনজি অটোরিকশা মালিকদের আর্থিক সক্ষমতা এবং যাত্রীদের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বছরের বছর ধরে ফিটনেস সনদ না নেওয়া অন্যান্য যানবাহনের মত সিএনজি চালিত অটোরিকশাগুলোকেও কোন জরিমানা ছাড়াই ২৭ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত ফিটনেস সনদ নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও অটোরিকশা মালিকদের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলে ফিটনেসবিহীন অটোরিকশার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।


অটোরিকশায় থাকা গ্যাস সিলিন্ডারগুলো কি আদৌ ব্যবহার উপযোগী?

সিএনজি চালিত অটোরিকশার ফিটনেস সনদ নবায়নের ক্ষেত্রে গ্যাস সিলিন্ডার রি-টেস্ট করানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদি পরীক্ষায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার উপযোগী বলে প্রমাণ থাকে তাহলেই অটোরিকশাটির ফিটনেস সনদ নবায়ন করা হয়ে থাকে। সিএনজি চালিত অটোরিকশায় ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারের অধিকাংশের মেয়াদ নেই। পাঁচ বছর পর পর পরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি মানছেন না চালক ও মালিকেরা। বছরে একবার মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ করতে চান না তারা। ফলে অটোরিকশার গ্যাস সিলিন্ডারগুলো প্রবল দূর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে।

 


বিআরটি সূত্র জানায়, সিএনজি চালিত অটোরিকশায় যেসব সিলিন্ডার সংযোজন করা হয়ে থাকে  সেগুলোর মেয়াদ বিশ বছর। কিন্তু গ্যাসের চাপ কম-বেশি হওয়ার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলোর কার্যক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পায়। এ কারণে পাঁচ বছর পর পর রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস  কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) বা তার অনুমোদিত সিএনজি সিলিন্ডার টেস্টিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিলিন্ডারগুলো পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল ফিটনেস সনদ মিলবে। এজন্য প্রতি বছর ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় সিলিন্ডার রি-টেস্ট রিপোর্ট দেখানোর নিয়মও রয়েছে। 

 


বগুড়ায় সিএনজি চালিত অটোরিকশার সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় এক দশক আগে বগুড়ায় প্রায় ৫টি সিলিন্ডার টেস্টিং প্রতিষ্ঠান চালু হয়। কিন্তু  তেমন গ্রাহক না পাওয়ায় ফলে ৪টি প্রতিষ্ঠানই  তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে টিএমএসএস সিএনজি কনভার্সন মটর ও অটো ওয়ার্কসপ নামে মাত্র একটি সিলিন্ডার টেস্টিং প্রতিষ্ঠানই টিকে রয়েছে। কিন্তু সেখানেও কোন গ্রাহক  নেই বললেই চলে। ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, রিটেস্ট ফি আড়াই হাজার টাকার বেশি নয়। কিন্তু তার পরেও অটোরিকশার মালিকরা পাঁচ বছর পর সেই সামান্য অর্থও খরচ করতে রাজি নন। যে কারণে হাজার হাজার সিএনজি চালিত অটোরিকশার মধ্য থেকে ২০১৮ সালে মাত্র ৫০টির গ্যাস সিলিন্ডার টেস্ট করা হয়েছে। তার পরের বছরগুলোতে হাতে গোনা ২/১টি করে অটোরিকশা মালিক এসেছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারগুলোর অনেকগুলো রীতিমত তাজা বোমার মত হয়ে গেছে। যে কোন সময় এগুলো বিস্ফোারিত হয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই স্থানীয় প্রশাসনের এদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। 

 


সিলিন্ডার রি-টেস্ট করাতে অনাগ্রহের কারণ অনুসন্ধানে অটোরিকশার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অধিকাংশই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। আর যারা জানেন তারা বাড়তি পয়সা খরচ করতে চান না বলেই নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। আমিনুর রহমান নামে এক সিএনজি অটোরিকশা মালিক জানান, গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষার বিষয়টি তার জানা নেই। বিষয়টি তিনি এই প্রতিবেদকের কাছ থেকেই প্রথম শুনেছেন বলেও উল্লেখ করেন। আবুল হোসেন নামে অপর একজনের ভাষ্য হলো- এখন পর্যন্ত কোন ধরণের ঝামেলা হয়নি। তাই সিলিন্ডার পরীক্ষা করা দরকার পড়েনি। অযথা কেন তিন টাকা খরচ করবেন? তবে কোন কোন চালক আবার মালিক পক্ষের ওপর দোষ চাপিয়ে বলেছেন, মালিক পক্ষ না চাইলে তাদের করার কিছু নেই। তাই সবকিছু জেনেও ঝুঁকি নিয়েই তাদের চলতে হয়।

 


বগুড়ায় বিআরটিএ’র সহকারি পরিচালক (প্রকৌশল) হারুন উর রশিদ জানান, অন্যান্য যানবাহনের মত সিএনজি চালিত অটোরিকশাগুলোকেও কোন জরিমানা ছাড়া ফিটনেস নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আশাকরি তারা ২৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যে সেটি করে ফেলবেন। তবে যারা এতে সাড়া দিবেন না তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অটোরিকশায় ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার রি- টেস্ট না করানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ৫ বছর পর পর এই পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক। ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে কোন অটোরিকশায়ই ফিটনেস সনদ পাবে না। এজন্য আমরা সেগুলোকে ফিটনেস নবায়নের আওতায় আনা জরুরী মনে করছি। রেজিস্ট্রেশনবিহীন অটোরিকশার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি’না এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতি সপ্তাহে একদিন করে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি। প্রয়োজনে আমরা আরও কঠোর হবো।’