আব্বাসীকে নিয়ে শেষ স্মৃতি সামনে আনলেন ফেরদৌসী রহমান
পুন্ড্রকথা ডেস্ক
বরেণ্য সংগীতজ্ঞ, শিল্পী, সুরকার, সংগ্রাহক, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী বেশ কিছু দিন কথাবার্তা বলতে পারতেন না। বাসায় কেউ গেলে তাকিয়ে থাকতেন। গত বৃহস্পতিবার তাকে তার গুলশানের বাসায় দেখতে গিয়েছিলেন ছোট বোন জীবন্ত কিংবদন্তি বরেণ্য সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান। এদিন তিনি ভাইয়ের পাশে অনেকক্ষণ বসেছিলেন। মাথায় হাত বুলিয়েছেন। হাত ধরেছেন। কিন্তু তাদের দুজনের মধ্যে কোনো ধরনের কথাবার্তা হয়নি। বৃহস্পতিবারের দেখাটাই দুই ভাইবোনের জীবিত অবস্থায় শেষ দেখা হয়ে রইল।
পল্লিগীতির সম্রাট অগ্রপথিক আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও লুৎফুন্নেসা আব্বাসের তিন সন্তান। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল ১০ বছর আগে মারা গেছেন। গতকাল শনিবার (১০ মে) চলে গেলেন আরেক ভাই দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী। বেঁচে রইলেন একমাত্র ছোট বোন ফেরদৌসী রহমান।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মুস্তাফা জামান আব্বাসী উপমহাদেশের খ্যাতনামা সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা আব্বাসউদ্দীন ছিলেন পল্লিগীতির অগ্রপথিক। এ দেশের পল্লিগীতিকে তিনিই প্রথম বিশ্বের সব দেশে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। চাচা আবদুল করিম ছিলেন পল্লিগীতি ও ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালির জনপ্রিয় শিল্পী। বড় ভাই মোস্তফা কামাল ছিলেন দেশের প্রধান বিচারপতি। বোন ফেরদৌসী রহমান ও ভাতিজি নাশিদ কামালও সংগীতাঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার স্ত্রী আসমা আব্বাসী একজন প্রথিতযশা শিক্ষক ও লেখিকা ছিলেন। তিনি গত বছর মারা গেছেন।
এদিকে কয়েক বছর ধরে দুই ভাইবোন নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় দিন পার করছিলেন। এর মধ্যে গতকাল ভোরে মারা যান মুস্তাফা জামান আব্বাসী। বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে শোকাহত ফেরদৌসী রহমান। একটি গণমাধ্যমে সেদিনের স্মৃতি তুলে ধরে ফেরদৌসী রহমান বলেন, সেদিন ভাইয়ের পাশে অনেকক্ষণ বসেছিলাম। মনটা খুব খারাপ করে বসেছিলাম। কোনো কথা বলছিল না। তারপর আমি বললাম, বউ (আব্বাসীর স্ত্রী) চলে গেল। রেজাও (স্বামী রেজাউর রহমান) চলে গেল আমাকে না বলে। তোর কী ইচ্ছা, আমাকে বল?
ফেরদৌসী রহমান বলেন, চল আমরা একটা কাজ করতে পারি—তুই আর আমি হাত ধরাধরি করে বলরামপুর, কোচবিহার চলে যাই, টুক করে। দার্জিলিংয়ে চলে যাই। আমরা কাউকে কিছু বলব না। আমাদের কেউ খুঁজেও পাবে না। এ কথা শোনার পর নড়লচড়ল। মনে হচ্ছিল, কথাটা ওকে স্পর্শ করেছে। এরপর হাত দুটি ওপরের দিকে তুলল। আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার মুখটা ধরার চেষ্টা করল। পরে আমি ওর একটা হাত ধরলাম। এটাই ছিল ওর সঙ্গে শেষ কথা। বৃহস্পতিবার জীবিত ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা বলেই কাঁদতে লাগলেন ফেরদৌসী রহমান।
এর আগে ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদে শোকাহত সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্টে ফেরদৌসী রহমান লিখেছেন—খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমার ভাই মুস্তাফা জামান আব্বাসী, যাকে আপনারা একজন মহান শিল্পী, গায়ক এবং লেখক হিসেবে জানেন, তিনি আজ সকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি তাঁর দুই কন্যা সামিরা ও শারমিনী এবং আত্মীয়স্বজন ও ভক্তদের একটি বড় দল রেখে গেছেন, যারা তার মৃত্যুতে শোকাহত। অনুগ্রহ করে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করবেন।
ঢাকার আজিমপুরে মা–বাবার কবরে দাফন করা হয়েছে দেশের বরেণ্য সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসীকে। বাবা আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও মা লুৎফুন্নেসা আব্বাসের কবরেই চিরনিদ্রায় শায়িত। এর আগে বাদ জোহর গুলশান আজাদ মসজিদে মুস্তাফা জামান আব্বাসীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, বনানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান মুস্তাফা জামান আব্বাসী। তার ছোট মেয়ে শারমিনী আব্বাসী জানান, তার বাবার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি দুই মেয়ে এবং বহু ভক্ত–অনুরাগী রেখে গেছেন। মেয়ে শারমিনী আব্বাসী জানান, বেশ কিছু দিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী। সর্বশেষ গত শুক্রবার শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। গতকাল শনিবার (১০ মে) ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।