নাপিত থেকে রফির কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী হয়ে ওঠার গল্প

পুণ্ড্রকথা ডেস্ক
প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:০২ ।
বিনোদন
পঠিত হয়েছে বার।

১৯৮০ সালে তার মৃত্যুর ৪৪ বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও রফির গানগুলো আকাশবাণী মুম্বাইয়ের বিবিধ ভারতী পরিষেবা এবং নয়াদিল্লি থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর উর্দু পরিষেবাতে এখনও একইভাবে ঠিক ততটাই জনপ্রিয়। প্রায়ই শোনা যায় সেইসব জনপ্রিয় গান।

 

দেশভাগ, দেশ স্বাধীন হওয়ার বহুপূর্বে তার জন্ম। ১৯২৪-এর ক্রিসমাসের ঠিক আগেই এই পৃথিবীতে এসেছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী মুহাম্মদ রফি। গতকাল ২৪ ডিসেম্বর গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে কিংবদন্তি এই শিল্পীর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে।

 

রফি যখন জন্মেছিলেন তখন (১৯২৪ সালে) তার জন্মস্থান পাঞ্জাবের মাঝা অঞ্চলের অমৃতসর জেলার কোটলা সুলতান সিং অন্যান্য গ্রামের মতোই ছিল। এখানকার বাসিন্দারা গবাদি পশু পালন করতেন। তার বয়সি অন্যান্য শিশুদের মতো ফিকোও (রফির ডাকনাম ফিকো) স্কুলের পর প্রতিবেশীর গবাদি পশু চরাতে নিয়ে যেতেন, আর গুনগুন করে লোকগীতি গাইতেন।

 

পরবর্তী সময় ১৯৪২ সালে ফিকো (রফি) তার বাবা হাজী মুহাম্মদ আলির সঙ্গে কাজে যোগ দেন। যিনি লাহোরে একটা ধাবা চালাতেন। এরপর রফি একটা সেলুনে নাপিতের চাকরি পেয়েছিলেন। খদ্দেরদের আড্ডা দিতে গিয়ে ওয়ারিস শাহের ‘হীর’ ও পিল্লুর ‘মির্জা’ গাওয়ার লোভ সামলাতে পারতেন না রফি। তার মিষ্টি কণ্ঠ নতুন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করত। সেখানকার এক স্থানীয় লাহোরের অল ইন্ডিয়া রেডিওর স্টুডিওতে ঘুরতে গিয়ে রফির সুরেলা কণ্ঠের গল্প করেন আকাশবাণী প্রধান জীবনলাল মাট্টুর কাছে। 

 

 

এরপর একদিন মাট্টু ওই নাপিতের দোকানে গিয়ে নিজের কানে ওই যুবকের গলা শুনতে পেলেন। এরপর তিনিই মুগ্ধ হয়ে রফিকে অডিশনের জন্য ডেকে পাঠান। এরপর তিনি পাঞ্জাবের লোকগায়ক হিসাবে অনুমোদন পেলেন। সেসময় রফিকে মাট্টুর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বুধ সিং তানের কাছে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছিল।

 

সেই তান-ই সেসময় রফির প্রতিভার পরিচয় পান। অল্প সময়ের মধ্যেই তার কণ্ঠ লাহোরের ফিল্ম স্টুডিওতে পৌঁছে যায় এবং নতুন সংগীত পরিচালক শ্যামসুন্দর গুল বালুচ নিজের ছবির জন্য রফিকে দিয়ে একটা পাঞ্জাবি গান রেকর্ড করান। 

 

যদিও সেই ছবি ফ্লপ হয়েছিল। গানের প্রতি রফির ভালোবাসা তাকে লাহোরে কিংবদন্তি ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খানের ভাই বরকত গুলাম আলি খানের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে রফি ‘খেয়াল’ এবং ‘ঠুমরি’র সূক্ষ্মতা আয়ত্ত করেন। পরে মুম্বাইয়ে এসে প্লেব্যাক গেয়ে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করার কথা ভাবেন। 

 

এরপর ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে রফি ট্রেনে করে নিজের স্বপ্নের শহর মুম্বাইয়ে পৌঁছে যান। তবে এরপর তার সামনেও ছিল দীর্ঘ লড়াই। ১৯৪৯ সালে, রফি তার প্রথম ব্রেক (সুযোগ) পান। পারফেকশনিস্ট সংগীত পরিচালক সাজ্জাদ হুসেন তাকে হীর ওয়ারিস শাহ গাইতে বাধ্য করেন। গানটি অবশ্য সেসময় হিট হয়েছিল।

 

প্লেব্যাক গাওয়ার ক্ষেত্রে মুহাম্মদ রফির ক্যারিয়ার শুরুর দিকের পরামর্শদাতা ছিলেন পণ্ডিত হুসান লাল। যিনি নিজে একজন পাঞ্জাবি। তিনিই রফিকে ভোর ৪ টায় তার তানপুরা নিয়ে নিজের বাড়িতে ডেকে আনতেন। রেকর্ডিংয়ের আগে কয়েকঘন্টা অনুশীলন চলত। বাজার (১৯৪৯) ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তার ডুয়েট গাওয়ার জন্য রফিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন শ্যাম সুন্দর।

 

সংগীত পরিচালক ফিরোজ নিজামী ‘জুগনু’ ছবির জন্য ‘নূরজাহান’ গানটি ডুয়েট গাওয়ার জন্য রফিকে বারবার অনুশীলন করিয়েছিলেন। রফির গাওয়া ডুয়েট ‘ইয়াহান বদলা ওয়াফা কা বেওয়াফাই কে সিওয়া কেয়া হ্যায়’ গানটি সুপারহিট হয়। এরপর ১৯৪৭ দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে পাঞ্জাবের ভাগ হয়ে যায়। সেই রক্তাক্ত বিভাজনে মুহাম্মদ রফি একটা আবেগঘন গান গেয়েছিলেন, ‘ইক দিল কে টুকড়ে হাজার হুয়ে কোই ইয়াহাঁ গিরা কোই ওহাঁ গিরা’। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে তিনি আরও একটা আবেগঘন গান গেয়েছিলেন। সেটি হল ‘সুনো সুনো অ্যায় দুনিয়া ওয়ালো বাপু কি ইয়ে আমার কাহানি’। এই দুটি গানেরই সুর দিয়েছিলেন হুসান লাল এবং ভগত রাম জুটি।

 

রফির কণ্ঠকে আরও উচ্চতায় পৌঁছে দেন উত্তরপ্রদেশের সুরকার নওশাদ আলি। রফির কণ্ঠে নওশাদের কিছু কালজয়ী সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে ‘ইয়ে জিন্দেগি কে মেলে দুনিয়া মে কাম না হোঙ্গে আফসোস হাম না হোঙ্গে’ (মেলা, ১৯৪৮), ‘সুহানি রাত ঢল চুকি না জানে তুম কাব আওগে’ (দুলারি, ১৯৪৯); ‘হিউ হাম জিনকে লিয়ে বরবাদ’ এবং ‘মেরি কাহানি ভুলনে ওয়ালে’ (দিদার, ১৯৫১); ‘ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে’ (বৈজু বাওরা, ১৯৫২); এবং ‘ইনসাফ কা মন্দির হ্যায় ইয়ে ভগবান কা ঘর হ্যায়’ (অমর, ১৯৫৪)।

 

মদন মোহন, হংস রাজ বেহল, শ্যাম সুন্দর, আল্লা রাখা কুরেশি, খৈয়াম, ওপি নায়ার, এস মহিন্দর এবং শার্দুল সিং কোয়াত্রা সহ সমস্ত পাঞ্জাবি সংগীত পরিচালকদের পছন্দের গায়ত হয়ে ওঠেন রফি।

 

১৯৮০ সালে না ফেরার দেশে যাত্রা করেন এই অমর শিল্পী। তার মৃত্যুর পর পার হয়েছে ৪৪ বছর। তবুও রফির গাওয়া গানগুলো একইভাবে জনপ্রিয় রয়ে গিয়েছে। আকাশবাণী মুম্বাইয়ের বিবিধ ভারতী পরিষেবা এবং নয়াদিল্লি থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর উর্দু পরিষেবাতে প্রায়শই শোনা যায় তার জনপ্রিয় সেই সব গান। মুম্বাই এবং অমৃতসরে তার অনুরাগীরা এই রূপালী পর্দার সোনালী কণ্ঠের সম্মানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন।